ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন, ২ বছরেও চালু হয়নি রংপুর শিশু হাসপাতাল
৮ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৩০
রংপুর: শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বিভাগীয় শহর রংপুরে একটি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সে অনুযায়ী নির্মাণ করা হয় ভবন। তিন বছর পর তড়িঘড়ি করে হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয় বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েও। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও দুই বছর। কিন্তু উদ্বোধনের পর এই দুই বছর আর ভবন নির্মাণের পাঁচ বছরেও ১০০ শয্যার এই হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবা এখনো আলোর মুখই দেখেনি।
স্থানীয়রা বলছেন, চালু না হওয়ায় বিভাগের আট জেলার সেবাপ্রত্যাশীরা বিশেষায়িত শিশু স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি এত বড় একটি স্থাপনা নির্মাণ করে কার্যক্রম শুরু না করায় সম্পদেরও অপচয় হচ্ছে। তারা দ্রুতই জনবল নিয়োগ দিয়ে বিশেষায়িত হাসপাতালটি চালুর দাবি জানান। আর স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, জনবল নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল শীতপ্রবণ এলাকা। অন্য সময়ে হাসপাতালে শিশু রোগীর চাপ থাকলেও শীতে শিশুদের রোগবালাইয়ের মাত্রা বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। এ সময়ে শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ, ঠান্ডাজনিত কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া ও অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ে। এ ছাড়া ভাইরাল ফ্লু, গলা ব্যথা, এবং অ্যালার্জিজনিত সমস্যাগুলোও প্রকট হয় শীতে। হাসপাতালগুলোতেও শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
স্থানীয়রা বলছেন, উত্তরের এই অঞ্চলে দুটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল— রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাপাতালে শিশু বিভাগ থাকলেও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে। আট জেলার রোগীর চাপ এই দুটি হসপাতালের পক্ষে বহন কা সম্ভবও হয় না। সেই চাপ কমিয়ে শিশুদের বিশেষায়িত স্বাস্থ্য সেবা দিতেই রংপুরে ১০০ শয্যার বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়।
নভেম্বর আসতে না আসতেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেল অপ্রতুলতার চিত্র। এই ওয়ার্ডে শিশু শয্যা রয়েছে মাত্র ৭২টি। প্রতিটি শয্যাতেই দুই থেকে তিনজন করে রোগী ভর্তি। ধারণক্ষমতার দুই থেকে তিন গুণ রোগীর পাশাপাশি তাদের অ্যাটেনডেন্টদের উপস্থিতিতে শিশু ওয়ার্ডে সেবা নিতে যাওয়া উলটো ভোগান্তিও তৈরি করছে।
জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা গ্রামে বাসিন্দা আয়ান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রংপুর মেডিকেলে শিশু ওয়ার্ডে বাচ্চা ভর্তি করতে হলে মানুষ বিপদে পড়ে যায়। একেকটা বেডে দুই-তিনটা করে বাচ্চা। কাউকেই কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতালটি চালু থাকলে রংপুর মেডিকেলের ওপর চাপ কমত। এখানকার রোগীদেরও ভোগান্তি হতো না।’
নগরীর ব্যাংক কলোনি এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিশেষায়িত একটি শিশু হাসপাতালের দাবি আমাদের দীর্ঘ দিনের। সামনে শীত। এখনো যদি শিশু হাসপাতালটি চালু করা যায়, মানুষের অনেক উপকার হবে। শুনেছি বিগত সরকার হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও জনবল দিতে না পারায় হাসপাতালটি চালু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, অবিলম্বে শিশু হাসপাতালটি চালু হোক।’
রোগীর চাপে হিমশিম খাওয়ার তথ্য স্বীকার করছে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। এখানকার শিশু ও নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ ওয়াহেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রংপুর মেডিকেলে একটি মাত্র শিশু বিভাগ। এতে রংপুর বিভাগের আট জেলার শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হলে স্বল্প মূল্যে শিশুদের জটিল সার্জারি ও সাধারণ রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডের কম শয্যায় সেবা ব্যাহত হওয়ায় স্বতন্ত্র বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল ভবনের নিচ তলায় গত ফেব্রুয়ারিতে বহির্বিভাগ চালু করা হয়। রমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিনটি কক্ষে অস্থায়ী ওই সেবা চালু করে। তবে এর সঙ্গে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতালের কোনো সম্পর্ক নেই।
শিশু হাসপাতালর চিকিৎসা কর্মকর্তা নুরজাহান ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু হাসপাতালের সঙ্গে এই শিশু বহির্বিভাগের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ভবন অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। তাই রংপুর মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এটাকে কিছুটা কাজে লাগিয়েছে মাত্র। জনবল নিয়োগ দিয়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে শিশু হাসপাতালটি চালু করা হলে এই অঞ্চলের শিশু রোগীদের জন্য অনেক উপকার হতো।’
এর আগে স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর রংপুর বিভাগীয় শহরে সিটি করপোরেশনের সামনে সদর হাসপাতালের জায়গায় এক একর ৭৮ শতাংশ জমিতে তিন তলায় ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতাল ভবনসহ আবাসিক কোয়ার্টারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর। এতে ব্যয় হয় ৩১ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার ৮০৯ টাকা।
তিন তলা মূল হাসপাতাল ভবনের নিচ তলায় জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ, চিকিৎসকদের চেম্বার, ল্যাব ও শিশুদের বিনোদনের সুব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় তলায় অস্ত্রোপচার কক্ষ (অপারেশন থিয়েটার) ও ব্রোন ইউনিট। আর তৃতীয় তলায় রাখা হয়েছে ওয়ার্ড ও কেবিন। এই ভবনের পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছে তিন তলা সুপারিনটেনডেন্ট কোয়ার্টার, ছয় তলা ডক্টরস কোয়ার্টার ও স্টাফ অ্যান্ড নার্স কোয়ার্টার। এ ছাড়াও রয়েছে বিদ্যুতের সাবস্টেশন ভবন।
জানা যায়, ২০২০ সালের ৮ মার্চ হাসপাতাল ভবনটি জেলা সিভিল সার্জনের কাছে হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। করোনা মহামারির সময় একে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন ওই সময়কার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা জানান, এরপর প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও শিশু হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়নি। এতে শিশুদের চিকিৎসায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছুটতে হচ্ছে রংপুর অঞ্চলের মানুষদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক পরিচালক আবু হানিফ ২০২৩ সালের ৫ জুন ৬৫৯ জনকে নিয়োগের প্রস্তাবনা দিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। এতে হাসপাতালের পেছনে বছরে ৪৬ কোটি ৫৬ লাখ তিন হাজার ৬৩৮ টাকা ব্যয় হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য ৬৫৯ জনবলের মধ্যে একজন তত্ত্বাবধায়ক, চিকিৎসকসহ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ১৮০ জন, নার্সসহ দ্বিতীয় শ্রেণির ১১৬ জন। এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণির ৬৩ জন ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ৩০০ জন।
জানতে চাইলে রংপুর বিভাগীয় (স্বাস্থ্য) উপপরিচালক ওয়াজেদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু হাসপাতাল ভবনটি নির্মাণের কয়েক বছর পর গত বছরের ৫ জুন জনবল নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি হাসপাতালটি চালু করার।’
হাসপাতালটি চালু হলে রংপুর বিভাগের আট জেলার শিশুদের চিকিৎসা সেবার চিত্র আমূল বদলে যাবে— স্বীকার করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের এই কর্মকর্তাও।
সারাবাংলা/টিআর