Tuesday 03 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাবি মেডিকেল যেন পারিবারিক পুনর্বাসন কেন্দ্র!

আরফাতুল ইসলাম নাইম, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট
৯ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টার

ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টার। ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য এই মেডিকেলে চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে আছেন ১০০ জন। আর এই ১০০ জনের মধ্যে বর্তমানে অন্তত ১৯ পরিবারের ৪০ জন কাজ করছেন।

ঠিক যেন সিনেমার মতো ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, কর্মকর্তার ছেলে কর্মকর্তা ও নিম্নমান পদে যারা চাকরি করেন তাদের ছেলেও সে পদে আসবেন- এমন নিয়মে চলছে ঢাবির শহীদ মোর্তজা মেডিকেল।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকদের পরিবারতন্ত্র

ঢাবি মেডিকেল সুত্রে জানা গেছে, ডা. শরিফ কমরুদ্দিন একজন চিকিৎসক। তার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পারিবারিক সূত্রে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাবি মেডিকেলে। আরেকজন ডা. জামিল আহমেদ সাইদী। তিনি ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূইয়ার ভগ্নিপতি। সাধারণ একজন চিকিৎসকের বাসা পেতে পয়েন্টের ভিত্তিতে অন্তত পাঁচ বছর লেগে যায়। সেখানে নিজামুল হক ভূইয়ার ভগ্নিপতি হওয়ায় সুবাদে চাকরিতে ঢোকার ছয় মাসের মধ্যে বাসা পেয়েছেন সাইদী।

ডা. সাঈদ আলী আনহার। বর্তমানে ঢাবি মেডিকেলের একজন চিকিৎসক। তার বাবা ডা. সাইদ উল্লাহ। তিনিও ঢাবি মেডিকেলের চিকিৎসক ছিলেন। বাবার সূত্রে সাঈদ চিকিৎসক হওয়ার পর নিজের স্ত্রী ডা. মাহবুবাকেও সেখানকার চিকিৎসক বানিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, ডা. মারজান কবির, যার বাবা ডা. ক্যাপ্টেন শাহজাহান ছিলেন মেডিকেল সেন্টারের একজন চিকিৎসক। যার পৈতৃক সূত্রে চিকিৎসক হয়েছেন ঢাবি মেডিকেলের। ডা. ফেরদৌস পূরবীর বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। বাবার সূত্রে পূরবীও এখন ঢাবি মেডিকেলের চিকিৎসক।

বিজ্ঞাপন

ডা. রুবাইয়া আক্তার (হোমিও) সহকারী মেডিকেল অফিসার। তার বাবা ডা. শাহজাহানও ছিলেন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার। ডা. শাফকাত জামি দায়িত্বে আছেন মেডিকেল অফিসার পদে। তার শ্বশুর ডা. জালাল আহম্মেদও সিনিয়র মেডিকেল অফিসার পদে রয়েছেন।

মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পরিবারতন্ত্র

মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট বেলাল সরকার। ২০১৩ সালে তিনি ঢাবি মেডিকেলে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র টেকনোলজিস্ট হন। উপাচার্য আকতারুজ্জামান ও মাকসুদ কামালের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন তার স্ত্রী ফাহিমা আকতারকে। এমনকি সিনিয়র অনেক কর্মকর্তাকে টপকিয়ে সবার আগে বাসাও পেয়েছেন।

প্রধান সহকারীদের পরিবারতন্ত্র

নাজমা বেগম ঢাবি মেডিকেলের প্রধান সহকারী অফিসার। তার বাবা আবদুল খালেকও একই পদে ছিলেন। আরেকজনের নাম সঞ্জয় কুমার রায়। কাজ করেন সেকশন অফিসার হিসেবে। তার বাবা বর্তমান স্টেট অফিসের দারোয়ান। মামুনুল হক নামের আরেকজন ঢাবি মেডিকেলের প্রধান সহকারী। তার শ্বশুরও কাজ করতেন এখানে।

এছাড়া, আনোয়ার হোসেন ঢাবি মেডিকেলের প্রধান সহকারী দায়িত্বে আছেন। তার বাবাও মেডিকেল সেন্টারে অফিস সহায়ক ছিলেন। মনির হোসেন নামে একজন কাজ করেন এখানে। তার বাবাও মেডিকেল সেন্টারে অফিস সহায়ক ছিলেন।

অফিস সহকারী, সহায়ক ও ড্রাইভারদের পরিবারতন্ত্র

শহীদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন মৃত স্বপন মিয়া। পরে তার স্ত্রী হেনা বেগমকে সেখানে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি পাইয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে হেনা বেগমের সূত্র ধরে তার ছেলে আবু হায়দার রাজু নিম্নমান সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান। এমনকি মেয়ে কলিও চাকরি পান কন্ট্রোলার অফিসের উচ্চমান সহকারী পদে। পরে রাজুর সূত্রে সহকারী মেডিক্যাল অফিসার পদে নিয়োগ পান তার স্ত্রী স্বপ্ন। এখন স্বপ্নের বোন জান্নাতুল ফেরদৌসও চাকরি করছেন ঢাবি মেডিকেলে।

খোরশেদ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অফিসে চাকরি করতেন। তার তিন ছেলে। বড় ছেলে রিপন মিয়া কাজ করেন ঢাবি মেডিকেলের অফিস সহায়ক হিসেবে। তার এক ভাই কাজ করেন স্টেট অফিসে। আরেক ভাই আইন বিভাগে।

মেডিকেল সেন্টারের ড্রাইভার ছিলেন আব্দুল মালেক। তার ছেলে মোহাম্মদ শরিফ (সিএমও এর পিয়ন) অফিস সহায়ক পদে চাকরি করেন। এমনকি আব্দুল মালেক ছেলের পাশাপাশি চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন শ্যালককে। মালেকের শ্যালক আলম হোসেন জয় বর্তমানে অফিস সহায়ক পদে কাজ করেন। একই পদে কাজ করেন ইকবাল গাজী নামে একজন। তার স্ত্রীও মেডিকেল সেন্টারে অফিস সহায়ক পদে আছেন।

ঢাবি মেডিকেলের কার ক্লিনার রফিক উল্লাহ। তার বাবাও মেডিকেল সেন্টারে ড্রাইভার পদে চাকরি করতেন। কামরুজ্জামান নামে একজন অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন মেডিকেলে। তার বাবা আব্দুস সামাদও সেখানকার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। আরেকজন হলেন গাজী মহিউদ্দিন বেলাল। তিনি চাকরি করেন ড্রাইভার হিসেবে। তার বাবাও মেডিকেল সেন্টারের ড্রাইভার ছিলেন। সেখানে আয়া হিসেবে কাজ করেন শারমিন আক্তার। তার স্বামীও (মৃত) ছিলেন সেখানকার ড্রাইভার।

সাবেক ভিসিদের ব্যক্তিগত ড্রাইভার পুনর্বাসন

ড্রাইভার সোলায়মান ছিলেন সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের ব্যক্তিগত ড্রাইভার। পরবর্তী সময়ে আরেফিন সিদ্দিক তাকে ঢাবি মেডিকেলের ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেন। এছাড়া, ড্রাইভার মামুন ছিলেন ভিসি মাকসুদ কামালের পারিবারিক ড্রাইভার। মাকসুদ কামাল ভিসি হওয়ার পর মামুনও নিয়োগ পান মেডিকেলের স্থায়ী ড্রাইভার হিসেবে। ঢাবি মেডিকেলের আয়া শাহানাজের স্বামীও (মৃত) ছিলেন ভিসি অফিসের ড্রাইভার।

এ বিষয়ে বর্তমান প্রধান মেডিকেল অফিসার ডা. তানভীর আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবারতন্ত্রের কারণে সেবার মান কমে গেছে। আমরা চেষ্টা করেও সেবার মান বাড়াতে পারছি না। প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।‘

এ বিষয়ে একাধিকরার ফোন দিয়েও ঢাবি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. সাইমা হক বিদিশাকে পাওয়া যায়নি। তবে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে একটি কমিটি করে দিয়েছি। যে কমিটি মেডিকেলের সার্বিক বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছে। আর পরিবারতন্ত্রের বিষয়ে যেটা বলছেন, সেটি সম্পর্কে আমরা সঠিক তথ্য জানি না। এটিও তদন্ত করে বের করা হবে।’

সারাবাংলা/এআইএন/পিটিএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পারিবারিক পুনর্বাসন কেন্দ্র শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর