এইচপিভি টিকা: স্কুল-মাদরাসায় বের হয়েছে ভুয়া শিক্ষার্থী
৯ নভেম্বর ২০২৪ ২২:২৪ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:০৮
রাজশাহী: রাজশাহীতে এবার এই থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধী এইচপিভি টিকা দেওয়ার সময়। স্কুল-মাদরাসায় খাতা-কলমে নাম থাকলেও স্বাস্থ্যকর্মীরা বাস্তবে শিক্ষার্থী খুঁজে পাননি। নির্দেশনা থাকলেও শিক্ষকেরা তাদের হাজিরও করতে পারেননি। কেউ কেউ স্বীকার করে নিয়েছেন, অনুপস্থিত থাকা শিক্ষার্থী বাস্তবেই নেই।
শিক্ষা বোর্ডের মঞ্জুরি বহাল রাখা কিংবা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ (এমপিও) চালু রাখার স্বার্থে স্কুল ও মাদরাসাগুলোতে খাতা-কলমে বাড়তি শিক্ষার্থী দেখানোর অভিযোগ পুরনো। তবে টিকা দিতে গিয়ে ভুয়া শিক্ষার্থী খুঁজে পেয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরা।
রাজশাহীর সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় স্কুলপর্যায়ে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ছাত্রীদের এইচপিভি টিকা দেওয়া শুরু হয় গত ২৪ অক্টোবর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়েই টিকা প্রয়োগ করা হয় ৭ নভেম্বর পর্যন্ত। আগামী ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহির্ভূত ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের জন্য ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে। রাজশাহীর ১ হাজার ৮৬টি প্রাথমিক, ৫৬০টি মাধ্যমিক, ২৪১টি মাদরাসা ও ২২২টি নন-ফরমাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিকা পাওয়ার উপযোগী হিসেবে তাদের ৯৯ হাজার ২৯৭ জন ছাত্রী থাকার কথা জানায়। কিন্তু বাস্তবে এই শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি। শেষ দিন পর্যন্ত টিকা নিয়েছে ৮১ হাজার ৫০০ জন ছাত্রী। অর্থাৎ, লক্ষ্যমাত্রার ৮২ শতাংশ ছাত্রী টিকা নিয়েছে। বাকি ১৮ শতাংশ ছাত্রী আসলেই আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় টিকা প্রয়োগের কাজে নিয়োজিত ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের এমটিইপিআই আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘টিকা প্রয়োগ শুরুর আগে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনবার করে গিয়েছি। কর্তৃপক্ষকে বলেছি, বাস্তবে যে শিক্ষার্থী সেই তালিকায় যেন আমাদের দেওয়া হয়। সেজন্য প্রথমবার যে তালিকা দেওয়া হয়, পরেরবার কিছুটা কম করা হয়। এ রকম পাওয়া গেলেও অনেক জায়গায় সমস্যা থেকেই গেছে। বেতন-ভাতা চালু রাখার জন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাতায় অতিরিক্ত শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে। ভয়ে শিক্ষকেরা আমাদের আসল তালিকা দেননি।’
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকে এ সমস্যা নেই, কিন্তু স্কুল ও মাদরাসায় আছে। স্কুলের চেয়ে আবার মাদরাসায় সমস্যা বেশি। আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে পরে কাজে গিয়ে (টিকা দেওয়ার সময়) আমরা সেটা পাইনি। ফলে আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সেটা অর্জিত হয়নি।’
স্কুল-মাদরাসায় টিকা প্রয়োগের সঙ্গে নিয়োজিতরা জানিয়েছেন, ‘মোহনপুর উপজেলার বাটুপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা থেকে ২৫ জন ছাত্রীর তালিকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুইদিন গিয়েও স্বাস্থ্যকর্মীরা ২৫ জন ছাত্রী পায়নি। সেখানে টিকা নিয়েছে মাত্র ১০ জন। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যকর্মীরা বাকি ১৫ ছাত্রীকে ডাকার জন্য শিক্ষকদের চাপ দেন। তখন মাদরাসার পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাস্তবেই মাদরাসায় আর ছাত্রী নেই।
গোদাগাড়ী দারুল উলুম মাদ্রাসা ২৯৫ জন ছাত্রীর তালিকা দিয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে টিকা নিয়েছে ১৯৩ জন। বাকি ১০২ জন শিক্ষার্থীকে খুঁজে পাননি স্বাস্থ্যকর্মীরা। গোদাগাড়ীর রাজাবাড়িহাট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১০০ জন। কিন্তু টিকা নিয়েছে মাত্র ৪০ জন। দুর্গাপুর উপজেলার গোপীনাথপুর দাখিল মাদরাসায় ছাত্রী দেখানো হয়েছিল ৬৯ জন, টিকা নিয়েছে ৫৯ জন। আর হোজা অনন্তকান্দি দাখিল মাদরাসায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৪ জন, টিকা নিয়েছে ৪৪ জন।
জেলা ইপিআই কর্মকর্তা কুস্তুরি বেগম বলেন, ‘আমরা বারবার বলার পরেও স্কুল কিংবা মাদরাসা থেকে আসল তালিকাটা দেওয়া হয়নি। বেশি সমস্যা হয়েছে মাদরাসাগুলোতে। অনেক মাদরাসায় যে সংখ্যক ছাত্রী বাস্তবেই নেই, তাদের নাম হাজিরার খাতায় লিখে রেখে শিক্ষার্থী বেশি দেখানো আছে। ফলে টিকা দিতে গিয়ে ছাত্রীকে পাওয়া যায়নি। এ কারণে আমাদের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি। অবশ্য অনেক ছাত্রী টিকা নিতে চায়নি, তাদের অভিভাবকেরা নাকি সম্মতি দেয়নি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার এটাও একটা বড় কারণ।’
খাতায় অতিরিক্ত ছাত্রীর তালিকা রাখার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়িহাট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাফরুদ্দিন বলেন, ‘আমি অসুস্থ। এখন কথা বলতে পারব না।’
দুর্গাপুরের হোজা অনন্তকান্দি দাখিল মাদরাসার সুপার চৌধুরী মো. আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, ‘আগে ছিল, পরে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে এ রকম ছাত্রীর নাম তালিকায় এখনও থাকতে পারে। তবে বেশি শিক্ষার্থী দেখাতে ভুয়া নাম খাতায় লিখে রাখার অভিযোগ একেবারেই সত্য নয়।’
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মো. ফারুক বলেন, ‘স্কুল ও মাদরাসাগুলোতে বাস্তবে নেই, এমন ছাত্রীর নামও লিখে রাখা হয়। এবার টিকা দেওয়ার সময়ও সেটা প্রতীয়মান হয়েছে। তবে এটা থাকা উচিত না। কারণ, ওই তালিকা ধরেই আমরা কাজ করি। সরকারকে লক্ষ্যমাত্রা দিই, আবার লক্ষ্যমাত্রা পূরণও হয় না। সেটা আমাদের জন্য খারাপ। তাই আসল তথ্যটাই স্কুল-মাদরাসায় লিপিবদ্ধ থাকা উচিত।’
রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মহা. জিয়াউল হক বলেন, ‘যে স্কুলে যত বেশি শিক্ষার্থী সে স্কুলের মঞ্জুরি তত বেশি সময়ের জন্য দেওয়া হয়। তাই অনেক সময় স্কুলগুলো বেশি শিক্ষার্থী দেখায় বলে আলোচনা হয়। কিন্তু আমাদের এটা সরাসরি যাচাই করার সুযোগ হয় না। মঞ্জুরির আবেদন এলে আমরা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদেরই বলি, তিনি যেন এই শিক্ষার্থীর সংখ্যা সত্য— এমন প্রত্যয়ন দেন। তিনি প্রত্যয়ন দিলে আমরা বোর্ডের মঞ্জুরি নবায়ন করে থাকি।
সারাবাংলা/এইচআই