‘ছাত্র-রাজনীতি সংস্কার করবে প্রশাসন, রূপরেখা দেবে ছাত্র-সংগঠন’
৯ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০৫
রাবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি সংস্কারের বিষয়টি সংগঠনগুলোর হাতে না থেকে যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন্দ্রিক একটা নীতিমালা হয় এবং সেই নীতিমালার ভেতরে যদি সবাই ছাত্র রাজনীতি চর্চা করে। যে ছাত্র রাজনীতি হবে শিক্ষামূলক, গবেষণামূলক। তবে এই ধরনের রূপরেখা যদি আমরা দিতে পারি তাহলেই কেবলমাত্র এই ছাত্র রাজনীতি সংস্কার করা সম্ভব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ছাত্র রাজনীতি সংস্কার প্রস্তাবে ছাত্র-নেতৃবৃন্দের বোঝাপড়া’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় রাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবদুল মোহাইমিন এসব কথা বলেন। শনিবার (৯ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে রাবি স্টুডেন্ট রাইটস অ্যাসোসিয়েশন।
শিবির সভাপতি বলেন, ‘ছোট বেলা থেকে আমরা যে ছাত্র রাজনীতি দেখে এসেছি সেটা আমিও নিষিদ্ধ চাই। কারণ এই ছাত্র রাজনীতি বলতে ছিল টেন্ডারবাজি, শিক্ষক নিয়োগে ছাত্রদের আধিপত্য, সিট বানিজ্য, প্রশ্ন ফাঁস করা এবং এই আদর্শের বাহিরে যারা ছিল তাদেরকে নিপীড়ন করে জেলে পাঠানো। তাই এই ছাত্র রাজনীতি শুধু সাধারণ ছাত্ররা না আমরাও নিষিদ্ধ চাই।’
ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে শিবির সভাপতি বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতিটা কেনো প্রয়োজন সেই বিষয়টা আমাদের জানা দরকার। আমরা জানি বাংলাদেশের যারা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন তাঁরা সকলেই রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিবর্গ। শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরার জন্য এই রাজনীতি সচেতন, রাজনীতি বিশ্লেষকরাই এসব চিন্তা ভাবনা করে থাকেন। সেজন্য ছাত্র রাজনীতি যে অবস্থায় তার রাজনীতি সচেতনতা, ব্যক্তি সচেতনতা, সামাজিক সচেতনতা তৈরি হয়, সেই তৈরির জায়গা থেকেই মূলত ভবিষ্যতে তার প্রভাবটা পড়ে। তাই ছাত্র রাজনীতি যদি না থাকে তাহলে ভবিষ্যতে দেশ নেতৃত্ব সংকটে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সুতরাং আমি বলবো ছাত্র রাজনীতি সেই সকল জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন, যেসকল কর্মকাণ্ডের কারণে আমরা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়েছি।’
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, ‘আমরা বিগত ১৫ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রাজনীতির যে প্রাকটিস দেখে আসছি সেটাকে আমরা রাজনীতি বলতে পারি না। আমরা দেখেছি ক্ষমতাসীন দলের কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে পদ পেলেই তিনি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক মনে করতেন। তারা ছাত্র রাজনীতি বলতে মনে করতেন হলের ক্যান্টিনে ফ্রি খাওয়া, শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা, নিজের আধিপত্য বিস্তার করা। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এ রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা চাই এই রাজনীতি থেকে বেরিয়ে নতুনভাবে রাজনীতির প্র্যাকটিস হোক। আমাদের আগামীর রাজনীতি হবে মানবিক রাজনীতি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মী নেতিবাচক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে না। যদি এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে আমরা সংগঠন থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবো।’
এসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তাসিন খান বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৯ দফার মধ্যে আমাদের একটা প্রাণের দাবি ছিলো লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং ছাত্র সংসদ চালু করা। বিগত ১৫ বছরে ছাত্র রাজনীতির নামে যা দেখেছি তা হলো হল দখল, সিট বানিজ্য, হানাহানি, ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া, গেস্টরুম কালচার, ক্যাম্পাসে পোস্টারিং এমনকি নির্মম হত্যাকাণ্ডও দেখেছি এই ছাত্র রাজনীতির নামে। ছাত্র রাজনীতি বলতে যদি এসবকেই বোঝায়, তাহলে ছাত্র রাজনীতি আমরা নিষিদ্ধ চাই। ছাত্রদের কল্যাণে আসে না এমন রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্চিত হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতি সচেতনতা না থাকলে, রাজনীতি চর্চা না থাকলে হয়তো আমাদের জুলাই অভ্যুত্থানও সম্ভবপর হতো না। সুতরাং সবার মধ্যে রাজনীতি সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। তবে সেটা জোরজবরদস্তিমূলক আধিপত্য বিস্তার নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার হরণ করা হবে বলে আমি মনে করি।’
শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে আগামীর ছাত্র রাজনীতি কেমন হবে এই বিষয়ে সমন্বয়ক তাসিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ দিতে হবে, অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী নির্বাচন দিতে হবে, ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলো পাঠচক্র, ম্যাগাজিন, ছোট কাগজ, সেমিনার ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে, ক্যাম্পাসে সংগঠিত কোনো নির্যাতন-নিপীড়ন যা ফৌজদারি আইনে পরিগণিত হয় সেটা প্রসাশন কর্তৃক দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনতে হবে, ক্যাম্পাসের সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, প্রশাসনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে, মত প্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে আধিপত্য বিস্তার করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও রাবি স্টুডেন্ট রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী সজিব বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থী সমাজ চাই একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ততে আর কোনো হল দখলের মতো ঘৃণ্য কাজ থাকবে না, সিট বানিজ্য থাকবে না, টেন্ডারবাজি থাকবে না। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার উন্নতর পরিবেশ গড়ে তুলতে। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণাগারে পরিণত করতে। সেই প্রচেষ্টাকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। আন্দোলনে আমাদের অন্যতম দাবি ছিলো লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা, যেটার মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে দেয়া এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সদা সোচ্চার থাকে। তাই আমরা স্পষ্ট বলে দিতে চাই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্যাম্পাসে কেন্দ্রের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দেয়াটা ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।’
আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও রাবি স্টুডেন্ট রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী মো. ফাহিম রেজা। এসময় আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার, রাবি রিচার্স সোসাইটির সাবেক সভাপতি সাকিবুল হাসান ও রাবি ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (সিডিএফ) সাবেক সভাপতি আশিকুর রহমান সোহাগ।
সারাবাংলা/এইচআই