টেস্ট ক্রিকেটে ২ যুগ: কতটা এগোল বাংলাদেশ?
১০ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:০৩
২০০০ সালের নভেম্বরের এক সকাল। হেমন্ত শেষে প্রকৃতি গাইছে শীতের আগমনী গান। বর্ণিল সাজে সজ্জিত বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। সেখানে গ্যালারিভর্তি দর্শক। হাতে হাতে পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার; তাতে দলের জন্য লেখা শুভকামনার বার্তা। ১০ নভেম্বর সেই শুভকামনা-সমর্থন রূপ নেয় হর্ষধ্বনি আর উল্লাসে, ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেটের মচ্ছব হয়ে। উপলক্ষ— বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট।
এই প্রজন্মের ক্রিকেটের দর্শক যারা, ইউটিউবে সার্চ করলে খুব বেশি হাইলাইটস হয়তো পাবেন না। তবে সার্চ রেজাল্টে যে কয়টা লো কোয়ালিটির ভিডিও আসবে, সেগুলোর প্লে বাটনে চাপলে তখনকার আনন্দঘন মুহূর্ত থেকে ঘুরে আসতে পারবেন নিশ্চিত। প্রযুক্তির কল্যাণে দেখতে পাবেন— উৎসবমুখর পরিবেশে কুয়াশামাখা রৌদ্রোজ্জ্বল এক সকালে গায়ে শুভ্র-সফেদ জার্সির ওপর ব্লেজার চাপিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে টস করতে নামছেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়। আরও একবার টাইম ট্রাভেল করে যেতে পারবেন ২০০০ সালের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সেন্টার উইকেটে। ঠিক সেই সময়টায়, যখন টস দিয়ে শুরু হলো কুলীন টেস্ট ক্রিকেটের পথে বাংলাদেশের যাত্রা।
এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ দুই যুগ। সময়স্রোতে ভেসে কত কিছুই বদলে গেল এই বদ্বীপে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ২০০৫ সালের পর থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ। দেশের ক্রিকেটের ঘর হয়ে উঠল মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়াম। যুগ বদলের উদাহরণ হিসেবে চাইলে আরও অনেক কিছুই দাঁড় করানো যায়। কিন্তু লাল বলের ক্রিকেটে কেমন কাটল বাংলাদেশের ২৪ বছর? যুগ বদলের সঙ্গে কতটা এগোল টেস্ট ক্রিকেটে? প্রায় দেড় শ ম্যাচ খেলে ফেলার পর প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তির খাতায় কী কী লিখতে পারল? টেস্ট ক্রিকেটের মানসিকতা-প্রক্রিয়া আদৌ কি আত্মস্থ করতে পেরেছে দলটা?
যৎসামান্য যে সাফল্য এসেছে, হাতের কড়েতে গুণে বলে দেওয়া যায়। এ পর্যায়ে এসে একটা প্রশ্নই ছুঁড়লাম আপনার দিকে— টেস্টে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য কী কী? উত্তরের মধ্যেও এমন কোনো রহস্য লুকিয়ে নেই, দেশের ক্রিকেটের ন্যূনতম খোঁজখবরও যারা রাখেন তারাও দিতে পারবেন শতভাগ সঠিক জবাব।
কদিন আগে পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের পর অজিদের বধ। শ্রীলংকায় শততম টেস্টে বাজিমাত। মাউন্ট মঙ্গানুইতে নিউজিল্যান্ডে প্রথমবার জেতা। হোম টেস্টে গত বছরের ডিসেম্বরে সেই নিউজিল্যান্ডকেই প্রথমবার হারিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দেশের প্রথম টেস্ট জয়ের মাহাত্ম্য আলাদা হয়েই লেখা থাকবে।
সাফল্য বলতে সাকুল্যেই এটুকুই। পরিসংখ্যান বলছে— ১৪৮ টেস্ট খেলার পর জয় এসেছে ২১টিতে, আর ১৮টি ম্যাচের নিষ্পত্তি হয়েছে ড্র’তে।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করি— বাংলাদেশ হেরেছে, এমন কয়টা ম্যাচের ঘটনা বলতে পারবেন? অনেক ম্যাচের কথাই হয়তো জানা আছে, অনেক পরাজয়েরই সাক্ষী আপনি। তবুও যদি একদম ঠিক সংখ্যাটা চান পরিসংখ্যান আপনাকে জানাবে— ১০৯টা ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ। তো বুঝতেই পারছেন, বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে বেশ অধারাবাহিক এক দল। যে রঙিন সাফল্যগুলো এসেছে লাল বলের ক্রিকেটে, সেসব মুছে গেছে হতশ্রী পারফরম্যান্স আর অ্যাপ্রোচে।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকেই তাকান। যে কাজটা নাজমুল হোসেন শান্তদের অগ্রজরা এর আগে কখনোই করতে পারেননি, সেটাই সম্ভব করে দেখালেন এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জেতা তো দূরের কথা, ম্যাচ জেতাই হয়নি আগে। হেড-টু-হেডে বাংলাদেশ পিছিয়ে ১২-০ ব্যবধানে। সেই রেকর্ড বদলে গেল এবারের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মিলে। পাকিস্তানকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে এলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা।
এমন দুর্দান্ত একটা সিরিজ কাটিয়ে ভারতে সফরে গেল বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাসী থাকার কথা পুরো দলের। সেটা হয়তো ছিলেনও ক্রিকেটাররা। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে যা হলো, ফলাফল কিংবা ক্রিকেটারদের অ্যাপ্রোচ দেখে আপনি এক সিরিজ আগের দলটার সঙ্গে তেমন কোনো মিলই পাবেন না।
কানপুরে দ্বিতীয় টেস্টে তিন দিন খেলাই হয়নি বৃষ্টির জন্য। মাত্র দুদিন আয়ুষ্কালের সেই টেস্টেও রেজাল্ট বের করে নিয়েছে ভারত! হ্যাঁ, ঘরের মাঠে ভারত তখনো অপরাজেয় এক দল। তখনো এক যুগ ধরে টেস্ট সিরিজ হারে না নিজেদের মাটিতে। তবুও দুদিনে একটা ম্যাচ হারা সম্ভব? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অন্তত এই কথা বলে দেওয়া যায়— যেকোনো পরিস্থিতিতে টেস্ট হারতে সক্ষম এই দল!
এরপর মিরপুর আর চট্টগ্রাম মিলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও হোয়াইটওয়াশ। ম্যাচের ফল কী হয়েছে, ভুলে যান। ম্যাচ জেতার তাড়না কিংবা কিছু করতে চাওয়ার শরীরী ভাষাটাও চরম মাত্রায় অনুপস্থিত ছিল গোটা দলে।
আরও কয়টা বছর পেছনে নিয়ে যাই। আনকোরা-নবাগত আফগানিস্তানের বিপক্ষেও টেস্টে হেরেছে বাংলাদেশ, তাও ঘরের মাঠে! ২০১৯ সালে মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা আফগানিস্তানই রীতিমতো বলেকয়ে ২২৪ রানে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশকে।
বছরের পর বছর অসহায় আত্মসমপর্ণে একপেশে হার— টেস্ট ক্রিকেট মানেই যেন বাংলাদেশের একই দৃশ্যের পুনর্প্রচার। যে কয়টা বড় জয় এসেছে, এসবের প্রভাবে সেগুলোকেও কেউ ফ্লুক বললে আপত্তি করার কিছু থাকে না। কারণ সাফল্য পেয়ে ধরে রাখতে পারা কিংবা নিদেনপক্ষে দলটা যে ঠিক পথে আছে সেই অনুযায়ী মাঠে খেলে দেখানোটাই তো মুখ্য। যখন টেস্ট স্ট্যাটাস ছিল কেবল ১০টা দেশের, তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল র্যাংকিংয়ের একদম শেষে। আয়ারল্যান্ড আর আফগানিস্তান নতুন করে পূর্ণ সদস্য হওয়ায় টেস্ট দল বেড়ে এখন ১২টা। বাংলাদেশ এখন নবম অবস্থানে। একে কি উন্নতি বলবেন?
হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত সাফল্যে টেস্ট ক্রিকেটে ‘শিরোনাম’ নিজেদের দিকে টানতে পেরেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই তো দেখতে হয়েছে মুদ্রার উলটো পিঠ। নেপথ্যে সেই একই কারণ— হতশ্রী পারফরম্যান্স, মানসিকতায় পিছিয়ে থাকা।
বারবার ঘুরেফিরে আসে সেই প্রসেস কিংবা প্রক্রিয়ার কথা, যেটা চলমান দীর্ঘদিন ধরেই, গুণকীর্তনও হয়। কিন্তু প্রক্রিয়ার ফল যদি পক্ষে না আসে, সফলতার খাতা ভারী না হয়, সেসব থেকে যায় অন্তরালেই। কারণ দিন শেষে মানুষ বিজয়ীদেরই মনে রাখে। টেস্ট ক্রিকেটের অঙ্গে বাংলাদেশ এখনো অনেক কাঁচা, পাস মার্ক তোলাটাই কষ্টসাধ্য। এত দিনেও মেলাতে পারেনি সমীকরণ ঠিকঠাক। পারলে অন্তত এই প্রতিবেদনের থিমটা এমন হতো না।
সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল ভারত সফরে গিয়েছিলেন ধারাভাষ্যকার হিসেবে। সেখানে স্পোর্টস্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এত দিনে বাংলাদেশের এই যৎসামান্য সফলতার কথা ভেবে তার লজ্জাই লাগে, ‘২৪ বছর টেস্ট খেলার পর আমরা এখনো উন্নতির কথা বলি, মোটেই ভালো কিছু না। মাঝেমধ্যে ভেবে লজ্জা লাগে যে এতদিন খেলার পরেও আমরা তেমন কিছু অর্জন করতে পারিনি।’
‘উন্নতি’— টেস্ট ক্রিকেটের প্রশ্নে এই শব্দটা টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচ, অধিনায়ক সবার মুখেই শোনা যায়। সংবাদ সম্মেলন কিংবা সাক্ষাৎকারে অগণিতবার এই শব্দ তাদের কাছ থেকে শুনেছেন। উন্নতি বলতে আসলে কী এখানে? উন্নতির ছোঁয়ায় রাতারাতি নিশ্চয়ই ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেওয়ার মতো দল হয়ে উঠবে না বাংলাদেশ।
তাহলে উপায়? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শেখার জায়গা না। বরং শিখে এসে অভিজ্ঞতা জমাতে জমাতে খেলে দেখানোর মঞ্চ, বিশেষত টেস্ট ক্রিকেট। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে— মুশফিকুর রহিম বা তামিম ইকবালদের মতো বাংলাদেশের গোল্ডেন জেনারেশনের ক্রিকেটাররাও বড় মঞ্চেই ঠেকে ঠেকে শিখে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছেন। কিন্তু এত দিনেও সেই চিত্রে খুব বেশি বদল আপনি দেখতে পাবেন না।
টেস্টে কেন বাংলাদেশ ভালো করতে পারে না— এমন প্রশ্নের উত্তরে নাজমুল শান্ত কিংবা গায়ে ‘টেস্ট ব্যাটার’ তকমা বসে যাওয়া মুমিনুল বারবারই বলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো ঠিক করতে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের রঞ্জি ট্রফি, ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এমন কিছু মুমিনুলরা হয়তো বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরীখে প্রত্যাশাও করেন না। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে তফাত কমিয়ে আনতে এর বিকল্পও কিন্তু নেই। নিদেনপক্ষে ভালো উইকেট, ভালো পারিশ্রমিক, ও সর্বোপরি ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সুগঠিত কাঠামোর দাবি তারা জানিয়ে আসছেন দীর্ঘিদিন ধরেই।
মুমিনুলও সোজাসাপ্টা জবাবেই কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে কি মনে হয় ফার্স্ট ক্লাস ও আন্তর্জাতিক ম্যাচের মান সমান? আমি বুঝি, কারণ, আমি ৫০-এর বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলছি। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে, তবে এটাই সত্যি যে আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে অনেক তফাৎ। আকাশ-পাতাল তফাৎ। এটা আমি আপনি সবাই জানে। এটা অজুহাত না, এটাই সত্যি। ঘরোয়া ক্রিকেটে আমি অতটা চ্যালেঞ্জ ফেস করি না, যতটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেস করি।’
মুমিনুলের এই এক কথাতেই পরিষ্কার— টেস্ট ক্রিকেটের দৌড়ে বাংলাদেশ এখনো কতটা পিছিয়ে। যে কারণে এখনো প্রায়ই হয়তো একেকটা টেস্ট হারের পর সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রতিনিধির কাছ থেকে শুনতে পান, ‘আমরা শিখছি’। সাধারণ ভক্ত-সমর্থকদের খড়গের সামনে ক্রিকেটাররাই পড়ে যান, তাদের ওপর দিয়েই যাবতীয় ঝড়ঝাপ্টা যায়। কিন্তু এর পেছনে দুর্বল কাঠামো, পরিকল্পনার অভাব, পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিং, ক্লাব রাজনীতি, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের প্রতি অবহেলা, ভালো উইকেট-সহ আরো নানান কারণ জড়িত।
টেস্ট ক্রিকেটের সামর্থ্য আর সক্ষমতার সূক্ষ্ম যে লাইনটা আছে, সেটাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ। সফলতার স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধারাবাহিকতা, অ্যাপ্রোচকে ধরলে বাংলাদেশ সেখানেও পিছিয়ে। শুরুর দিনগুলোতে পাঁচ দিন পর্যন্ত খেলতে পারাটাই ছিল বাংলাদেশের কাছে কৃতিত্বের সামিল। কিন্তু এই দুই যুগ পরেও দেখুন, বাংলাদেশ বিদেশের মাঠে টেস্ট হারছে দুই দিনে। চেনা আলো-হাওয়ায় হোম টেস্টেও খেলতে পারছে না তিন দিনের বেশি।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ আদৌ কি এগিয়েছে এই দুই যুগে? নাকি যেখানে শুরু করেছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে?
সারাবাংলা/জেটি/টিআর