ডিটিএইচ সেবা
সালমানের ‘আকাশ’ আসতে দেয়নি ‘বেঙ্গলের স্কাই’কে
১১ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:২৫
ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। তার মালিকানাধীন ডিরেক্ট-টু-হোম (ডিটিএইচ) সেবা ‘আকাশ’ সারা দেশে একচেটিয়া ব্যবসা করছে। এই ব্যবসায় যাতে কেউ ভাগ বসাতে না পারে সেজন্য ডিটিএইচ’র লাইসেন্স নবায়ন থাকলেও বেঙ্গল গ্রুপের ‘বায়ার মিডিয়া’কে তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়নি বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)।
অভিযোগ রয়েছে, মূলত সালমান এফ রহমানের ইশারাতেই ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অথচ স্যাটেলাইটের বেশকিছু ট্রান্সপন্ডার এখনও অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ডিটিএইচ সেবা চালু করতে স্যাটেলাইট কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করছে বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেড। সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে আগামী বছরের শুরুর দিকেই বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেডের ‘বেঙ্গল স্কাই’র ডিটিএইচ সেবা পেতে পারেন গ্রাহকরা। স্যাটেলাইট কোম্পানি ও বেঙ্গল গ্রুপের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
ডিটিএইচ সেবাদাতা হিসেবে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র বেক্সিমকোর মালিকানাধীন আকাশ-ই বাজারে রয়েছে। বিটিভির নামে ডিটিএইচ সেবার লাইসেন্স থাকলেও সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি বাজারে এই সেবা চালু করেনি। আর বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেডের ‘বায়ার মিডিয়া’ নামক প্রতিষ্ঠানের ডিটিএইচ সেবার ব্র্যান্ড নেইম ‘বেঙ্গল স্কাই’, প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স রয়েছে। ফি পরিশোধ থাকায় প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স এখন পর্যন্ত নবায়ন রয়েছে।
সলমান এফ রহামানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো যাতে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারে সে কারণেই প্রতিষ্ঠানটিকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। আর তরঙ্গ বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিও সেবা চালু করতে পারেনি। এতে বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেড যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানিও। ট্রান্সপন্ডার ভাড়া না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আয় করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটও।
ডিটিএইচ সেবা নিয়ে ‘আকাশ’র বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কেউ কথা বলতে রাজি হননি। আর বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বেঙ্গল গ্রুপ কেন ডিটিএইচ সেবা চালু করতে পারেনি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন লাইসেন্স পাই তখনই পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ বছরের লাইসেন্স ফি জমা দেওয়া আছে। কিন্তু আমাদের তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়নি। তখন বলা হলো, মেজর ডালিমের ভগ্নিপতি বলে আমাকে কোনো কেপিআইতে (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান) তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমার নামে তো কোনো মামলা নেই। প্রতিষ্ঠানটির তরঙ্গ কিন্তু বিক্রি করতে পারিনি। আমাদের আটটি ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নেওয়ার কথা ছিল। ডালিমের ভগ্নিপতি বিধায় তখন বরাদ্দ দিল না। আমার লাইসেন্স ভেলিড আছে। এখন আমরা অ্যাপ্লাই করব।’ এক প্রশ্নের জবাবে আবুল খায়ের বলেন, ‘তখন ওই সময়ের চেয়ারম্যান (শাহজাহান মাহমুদ) আমাদের এ কথা (ডালিমের ভগ্নিপতির কারণে নিরাপত্তা ইস্যু) জানিয়েছিলেন। সেটি মৌখিকভাবে বলেছে এবং ফাইলেও লিখেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে বরাদ্দ দিলে সেটি সালমানের (সালমান এফ রহমান) এগেইনস্টে চলে যাবে। তারা মনোপলি করার কারণে আমাকে তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অথচ এই ব্যবসার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। তখন এটি নিয়ে কোথাও কিছু বলিনি। কারণ, অভিযোগ দিলে তো সে (সালমান) আমাকেই ধরিয়ে নিয়ে যাবে।’
বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ডিটিএইচ সেবা চালু করতে আমি অ্যাপ্লাই করেছি। আমাকে তরঙ্গ বরাদ্দ দিলে আমি আগামী মার্চ বা এপ্রিল মাসেই সেবাটি বাজারে নিয়ে আসব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএসসিএল’র সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিটিএইচ করার জন্য বিটিভিকেও লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তাদের সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সবধরনের সহায়তা দেওয়া হবে জানানোর পরও তারা এগিয়ে আসেনি। বেঙ্গলেরও ডিটিএইচ লাইসেন্স ছিল। তবে রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠানটিও এগিয়ে আসেনি। ফলে আকাশ এই ব্যবসায় একচেটিয়া হয়ে ওঠে।’
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড এর মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) শাহ আহমেদুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিটিএইচ সেবা দিতে বেঙ্গল গ্রুপ লাইসেন্স নিয়েছিল। তাদের লাইসেন্স আপডেট রয়েছে। ৫ আগস্টের পর তারা এখন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তারা এখন ব্যবসা করতে চায়। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায় এলে আমাদের অব্যবহৃত অনেক ব্যান্ডউইথ বিক্রি হবে। স্যাটেলাইট কোম্পানির আয়ও বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন প্রাক্কলন করেছিলাম, তখন ধরেই নিয়েছিলাম অন্তত দুই/তিনটি ডিটিএইচ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান থাকবে। তবে তখন বেঙ্গল এগিয়ে না আসায় ও বিটিভি তাদের ডিটিএইচ সেবা চালু না করায় অনেক ব্যান্ডইউথ অবিক্রিত থেকে গেছে।’
বিএসসিএল’র তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ছিল ৯৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, বিপরীতে ব্যয় ১৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ১২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা, ব্যয় ২৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় ১৩০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ও ব্যয় ২৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় ১৪৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ও ব্যয় ৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আয় ১৬৩ কোটি ও ব্যয় ৪৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছরই স্যাটেলাইট কোম্পানির আয় বাড়ছে। তবে এখনো খরচ তুলতে পারেনি তারা।
এ বিষয়ে স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) শাহ আহমেদুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০৩০ থেকে ৩১ সালের মধ্যে স্যাটেলাইট কোম্পানি ব্রেক ইভেনে আসার কথা। আমরা যদি সব ব্যান্ডউইথ বিক্রি করতে পারি, তবে তার আগেই আমরা লাভের মুখ দেখতে পারব। তখন বিনিয়োগ উঠে আসবে।’
স্যাটেলাইট কোম্পানির তথ্য মতে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এ ‘সি ব্যান্ডের’ ট্রান্সপন্ডার রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ বিক্রি হয়েছে, ৩৯ শতাংশ সংরক্ষিত ও ২ শতাংশ অবিক্রিত রয়ে গেছে। আর ‘কে ইউ ব্যান্ডের’ ট্রান্সপন্ডার রয়েছে ২৬টি। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ বিক্রি হয়েছে, ৭ শতাংশ সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যবহৃত, ১৭ শতাংশ সংরক্ষিত ও ৫১ শতংশ অবিক্রিত রয়েছে। ২০৩৪ সালে এই স্যাটেলাইটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে পরবর্তী ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের।
দেশে স্যাটেলাইটের সেবা নিচ্ছে যারা
দেশের সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, আকাশ ডিটিএইচ ও কয়েকটি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সেবা নিচ্ছে। এছাড়া, এয়ারকম মিডিয়া লিমিটেড, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, সিভিল অ্যাভিয়েশন অব বাংলাদেশ, মৎস্য অধিদফতর, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, বেক্সিমকো ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, স্কয়ার ইনফরমেটিক্স লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ বাংলা ব্যাংক, কার্নিভাল ইন্টারনেট, টোটাল ব্রডক্রাস্টিং নেটওয়ার্ক এলএলসি (টিবিএন) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গ্রাহক। এছাড়া, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অবশিষ্ট ব্যান্ডউইথ বিক্রির প্রচেষ্টা ও আলোচনা চলমান রয়েছে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম