কপ সম্মেলন কী, পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা কেন তাকিয়ে এর দিকে
১২ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৫৩
পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষণা সংস্থাগুলো আভাস দিচ্ছে, এ বছরই প্রথমবারের মতো বিশ্বের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তি থাকবে। এমন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এ শতাব্দী শেষে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দাঁড়াবে সেই প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশিতে, যা জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের।
এমন আশঙ্কার মুখে আজারবাইজানের বাকুতে শুরু হয়েছে কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস তথা কপ সম্মেলন, যেখানে জড়ো হয়েছেন বিশ্বনেতারা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে এই সম্মেলনে। প্রত্যাশা— বিশ্বনেতারা জলবায়ু পরিস্থিতি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেবেন।
সোমবার (১১ নভেম্বর) বাকুতে শুরু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ুবিষয়ক এই সম্মেলন। এটি কপের ২৯তম সম্মেলন, যাকে ডাকা হচ্ছে কপ২৯ নামে।
সারা বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদসহ সংশ্লিষ্টরা সবার চোখ এখন বাকুতে কপ২৯ সম্মেলনের দিকে। গুরুত্বপূর্ণ এই সম্মেলনটি প্রকৃতপক্ষে কী, কেন হয়, কখন সংঘটিত হয়, এর ইতিহাস ও কার্যক্রম কী কী— এসব তথ্যই এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই প্রতিবেদনে।
কপ সম্মেলন কী?
কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস (সিওপি) বা কপ হলো একটি বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) সদস্য দেশগুলো আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য এই সম্মেলনে একত্রিত হন। বিশ্বের পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) সদস্যরা এই সম্মেলন থেকে বৈশ্বিক জলবায়ু নীতি প্রণয়ন করে থাকেন।
কোথায় অনুষ্ঠিত হয় কপ?
প্রতি বছর জাতিসংঘের পাঁচটি নির্ধারিত অঞ্চল (আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপ, এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান) থেকে পর্যায়ক্রমে কোনো একটি দেশকে কপ প্রেসিডেন্সি ঘোষণা করা হয়। সাধারণত কপ প্রেসিডেন্সির দায়িত্বে থাকা দেশেই অনুষ্ঠিত হয় কপ সম্মেলন। তবে কোনো কারণে ওই দেশ সম্মেলন আয়োজনে অপারগ হলে সেটি জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত হয়।
কয়টি দেশ কপ সম্মেলনে অংশ নেয়?
কপের বর্তমান ‘পার্টি’ সংখ্যা ১৯৮, যার মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) সদস্য ১৯৭টি দেশ ও একটি অঞ্চল— ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই ‘পার্টি’দের সবাই অংশ নেয় কপ সম্মেলনে। সে হিসেবে বিশ্বের প্রায় সব দেশই কপ সম্মেলনে অংশ নেয়। আগের বছরগুলোর মতো এ বছরও বাংলাদেশ কপ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে।
কারা অংশ নেয় কপ সম্মেলনে?
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা যোগ দেন কপ সম্মেলনে। তবে সম্মেলনে অংশ নেওয়া বড় অংশ বিভিন্ন পর্যবেক্ষক গোষ্ঠীর, যাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে কপ সিভিল সোসাইটি। আমন্ত্রিত এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে পরিবেশবিষয়ক এনজিও (ইএনজিও), আদিবাসী জনগণ (আইপিও), গবেষণা প্রতিষ্ঠান (রিংগো), নারী ও লিঙ্গ গোষ্ঠী (ডব্লিউজিসি) এবং যুব এনজিও (ওয়াইএনজিও)। প্রায় ৩০ হাজার অংশগ্রহণকারী নিয়ে কপে অনেক পার্শ্ব ইভেন্ট, প্যানেল আলোচনা, প্রতিবাদ এবং উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। এসবের মধ্য দিয়ে বিশ্ব জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু পদক্ষেপের প্রধান ইভেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে কপ।
কপ সম্মেলনের উদ্দেশ্য কী?
কপ সম্মেলনের প্রধান ভূমিকা হলো কনভেনশন ও এর আইনি প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন পর্যালোচনা, জলবায়ু লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি মূল্যায়ন এবং কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
কপ মূলত ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রধান মঞ্চ হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন: জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ
কপ সম্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয়?
এটি প্রায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে বা ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে কেবল এটি স্থগিত করা হতে পারে, যেমনটি করা হয়েছিল কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির সময়। প্রতিটি বৈঠকেই ধারাবাহিক ক্রমিক আকারে প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ কিছু চুক্তি সম্পাদিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কিয়োটো প্রোটোকল ও প্যারিস চুক্তি।
এ বছর ২৯তম কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজারবাইজানের বাকু শহরে। এবারের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে জলবায়ু অর্থায়ন, যেখানে বিশ্বনেতা ও অংশীদাররা একটি নতুন সম্মিলিত লক্ষ্যমাত্রা (এনসিকিউজি) নির্ধারণে আলোচনা করবেন।
কপ সম্মেলন কীভাবে শুরু হলো?
১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত আর্থ সামিটে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএনএফসিসিসি। সেখানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে থেকেই কপ সম্মেলনের সূচনা হয়।
প্রথম কপ বৈঠক ১৯৯৫ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে বার্ষিক কপ বৈঠকগুলো বৈশ্বিক জলবায়ু নীতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বখ্যাত এই সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য মাইলফলকগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রোটোকল ও ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি।
এ বছরের কপ সম্মেলনের মূল আলোচনার বিষয়বস্তু কী?
এ বছরের কপ সম্মেলন হবে অর্থনৈতিক আলোচনাকেন্দ্রিক। এবারের সম্মেলনকে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ‘অর্থায়ন কপ’ নামে অভিহিত করেছে, যা এ বছরের এজেন্ডায় অর্থায়ন আলোচনাকে গুরুত্ব দেবে।
গত ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের অংশীদাররা একটি নতুন এনসিকিউজি নিয়ে আলোচনা করবেন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু পদক্ষেপে সহায়তার জন্য বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রাকে পর্যালোচনার মাধ্যমে নতুন পরিমাণে উন্নীত করবে।
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এই নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনেক বাড়িয়ে ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের উন্নীত করতে চায়, যেন জলবায়ু সংকটের ক্ষতি কিছুটা হলেও পূরণ করা যায়।
কপ সম্মেলন-২৯ এর একটি প্রধান লক্ষ্য হবে ক্ষয়ক্ষতিজনিত ও ক্ষতিপূরণ তহবিল (এফআরএলডি) কার্যকর করা, যা ২৮তম কপ সম্মেলনে সম্পাদিত হয়েছিল। এই তহবিলটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতিকূল প্রভাব এড়াতে এবং দেশগুলোকে সহায়তা করতে পরিচালিত।
বিশ্বনেতারা এফআরএলডিকের মূলধন গঠনের জন্য নতুন আর্থিক প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করার পরিকল্পনা করছেন এবং এনসিকিউজি টু-এর সঙ্গে এর ব্যবস্থাগুলো সমন্বয় করবেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ক্ষেত্র হবে প্যারিস চুক্তির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের নিয়মাবলি, যা আন্তর্জাতিক কার্বন ট্রেডিংয়ের কাঠামো নির্ধারণ করে। এই নিয়মাবলি বৈশ্বিক কার্বন বাজার স্থাপনের জন্য অপরিহার্য, যা কার্বন নির্গমন হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সারাবাংলা/এসডব্লিউ/টিআর