‘সাধারণ মানুষ এখনো মুক্তির পথ সন্ধান করছে’
১৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:১৩
ঢাকা: এখনও শ্রমজীবী জনগণ ও সাধারণ মানুষ মুক্তির পথ সন্ধান করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম।
শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজন ও আহত ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘প্রায় ১০০ দিন হয়েছে এখানে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। অভ্যুত্থানের শক্তির ওপর যদি এই সরকার গঠিত হত, তাহলে নিশ্চয়ই এই সংগ্রামে যারা নিহত যারা হয়েছেন, প্রতিরোধ যারা গড়ে তুলেছিলেন, বিশেষ করে যারা গরিব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, মেহেনতী মানুষ তাদের একটা প্রতিনিধিত্ব থাকত। আমরা দেখেছি, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা অন্তর্বর্তী সরকার এখানে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত শ্রমজীবী জনগণ, সাধারণ মানুষ মুক্তি কোন পথে, তা সন্ধান করছেন।’
‘কেননা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে মূলবৃদ্ধি, সেই মূল্যবৃদ্ধি যে ব্যবসায়ী শ্রেণি করছে, যে আমলাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে করছে, তাদেরকে এই সরকার এখন পর্যন্ত নিন্ত্রণ করতে পারেনি। এটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে’— বলেন ফয়জুল হাকিম।
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি আমলাতন্ত্রে পরিস্থিতি। এই কয়দিন আগে আমাদের আহত ভাইয়েরা, যারা সেই শ্যামলীতে সরকারি যে হাসপাতাল, যাকে বলে পঙ্গু হাসপাতাল, সেই পঙ্গু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে তারা রাস্তা অবরোধ করছেন। কেননা, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তাদের দেখতে যাননি।’
ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের সাথে সাক্ষাতের অংশ হিসেবে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার সাথে যখন দেখা করেছিলাম, তার আমন্ত্রণে কথা বলেছিলাম জনগণের বিভিন্ন দাবি নিয়ে, শেষে তাকে বলেছিলাম যে, আপনি কী মনে করবেন জানি না, কিন্তু একটা কথা বলা দরকার, আপনার এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডায়নামিক না, তিনি কোনো কার্যকর না, তার ব্যাপারে ভূমিকা নেন। তো সে কথা তো তারা শোনে নি। তাই আজকে এই পরিস্থিতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দেখা গেছে জনগণের ক্ষমতা কী? বিদ্যমান সংবিধানকে নাকচ করে দিয়ে এই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের একটা কর্তৃত্ব এখানে উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু, সেই কর্তৃত্বকে ধারণ করার জন্য জনগণের অভ্যুত্থানের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে ‘একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার’ এখানে হয়নি। ফলে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে পেরেছেন। তাকে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। বহু গণদুশমন, ফ্যাসিবাদের দোসর, খুনি, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি অনেকেই পালিয়ে গিয়েছেন। কীভাবে তারা পালিয়ে যান, কারা তাদেরকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে? তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে?’
ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘এই অভ্যুত্থানে আমাদের কমরেডরা, তরুণরা এবঙ আমরা যারা ছিলাম তারা অনেকেই মৃত্যুবরণ করতে পারতাম, তারা অনেকেই মারাত্মক আহত হতে পারতাম। অভ্যুত্থানের পর আমরা চিন্তা করলাম ঢাকায় বিশেষ করে বাড্ডা, রামপুরা শনির আখড়া এলাকায় যে প্রবল প্রতিরোধ হয়েছিল এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনকে নিশ্চিত করেছিল, তাদের সাথে আমরা দেখা করব। তাদের বাড়ি বাড়ি আমরা গিয়েছিলাম। আমরা আমাদের কমরেডদের বলেছি, সেই আগুনের তাপ আমাদের নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যারা জীবন দিয়েছিলেন, যারা সাহসের সঙ্গে এই পথে গিয়েছিলেন— এখানে উপস্থিত আছেন বাড্ডা একটি স্কুলের ছাত্র- রিফাত। ফুটবল খেলার তার খুব শখ ছিল, নবম শ্রেণির ছাত্র। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তুমি গিয়েছিলে কেন? বলল, আমার বড় ভাইদের এভাবে মারছে আংকেল, আমি ঘরে থাকি কী করে?’
ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম তখন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমাদের বাবা গিয়েছিলেন, চাচারা গিয়েছিলেন। আমি দেখেছি এই নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের, কীভাবে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের রাষ্ট্র অবজ্ঞা করেছে। এই সমাজে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কোনো মূল্য এই রাষ্ট্র দেয়নি। আর এখন আমরা দেখি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। গলা ফুলিয়ে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে গত ১৫ বছর এই দেশটাকে রসাতলে দেওয়া হয়েছিল, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, দেশকে ভারতে গোলাম বানানো হয়েছিল, দিল্লির দাস হিসেবে আমাদের তৈরি করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তরুণরা প্রমাণ করেছে আমরা দাস হয়ে বাঁচব না, গোলাম হয়ে বাঁচব না, আমরা স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে জনগণ, তার সন্তানরা গিয়েছিল, তেমনি নব্বয়ে ২০২৪ এর জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে তারা গিয়েছিল যে, ফ্যাসিবাদের পতন হবে, জনগণের হাতে ক্ষমতা আসবে। সুতরাং আমরা মনে করি, জনতার হাতে ক্ষমতা আনার জন্য লড়াই চলবে। সে জন্য এই অভ্যুত্থানের আগুনকে আমাদের জাগিয়ে রাখতে হবে।’
ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘‘সমাজের মধ্যে যে আগুন চাপা ছিল ১৫ বছর ধরে। শত শত মানুষকে গুম করা হয়েছে, বিচার বহির্ভুতভাবে হত্যা করা হয়েছে, মেজর সিনহাকে হত্যা করার পর সাংবাদিক ভাইয়েরা জানিয়েছিলেন, ওসি প্রদীপ নাকি ২০০ এর উপরে লোক মেরেছে।’’
তিনি বলেন, ‘এই জনপদে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু, ৭২ এর সংবিধান পড়লে মনে হয় এই জনপদে মানুষ কেবল পাকিস্তান আমলে আন্দোলন করেছে। এর আগে জনগণের আন্দোলনের কোনো ইতিহাস নাই। ইতিহাস খুলে দেখুন, এই জনপদে কত আন্দোলন হয়েছে। কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে, তিতুমীরের আন্দোলন হয়েছে, ফকির সন্যাসী বিদ্রোহ হয়েছে, নান রকম জনগণের সংগ্রাম হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই হয়েছে, এই সংবিধান পড়ে তো সেটা বোঝা যায় না।’
ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘এই সংবিধানের মূল নীতির মধ্যে নাই বাংলাদেশ হবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক একটা বাংলাদেশ। সে কারণে সংবিধান কমিশনে গিয়ে আমরা পরিষ্কাভাবে বলেছি- নতুন গণতান্ত্রি সংবিধানের জন্য সংবিধান সভা নির্বাচন করতে হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণকে সমান অধিকার দিতে হবে। এই দেশ বহু জাতির দেশ। শুধু বাঙালিরা না, এখানে নানা জাতি সত্ত্বার লোক রয়েছে, ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগণ রয়েছেন। সুতরাং সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মানুষের অধিকার এখানে থাকতে হবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন লেখক শিবিরের সভাপতি মঈনুদ্দীন আহমেদ, ছাত্র ফেডারেশনের সহ-সভাপতি দিপা মল্লিক প্রমুখ।
অনুষ্ঠান জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করেন বাড্ডায় নিহত হাফিজুল সিকদারের শ্বাশুরি নাসিমা বেগম, বাড্ডায় নিহত ইমনের মা কুলসুম বেগম, বাড্ডায় আহত স্কুল ছাত্র মো. রিফাত হাওলাদার, নিহত রায়হানের বাবা মোজাম্মেল হোসেন,যাত্রাবাড়ীতে আহত সাদ্দাম হোসেন সূর্য প্রমুখ।
সারাবাংলা/এজেড/এমপি