সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের কাছে পৌঁছায় জলবায়ু অর্থায়ন?
১৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:১০
গত বছরের সেপ্টেম্বরে লিবিয়ার দেরনা বন্দর শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল। ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের পাশাপাশি ভারী বৃষ্টিপাতে দুটি বাঁধ ভেঙে দেখা দেয় বন্যা। এতে আশপাশের এলাকাগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাজারখানেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে সেই ঘূর্ণিঝড় ও এর প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এমন ধরনের ঘটনার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে, যা ৫০ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতাও আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি হতে পারে।
লিবিয়ায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে যে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি, এর জন্য কয়েক দশকের সংঘাতের কারণে বিনিয়োগের ঘাটতিকে দায়ী করেছে জাতিসংঘ। সেখানে বহু দিনের পুরনো বাঁধ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ধাক্কা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাঁধগুলো পুনর্নির্মাণ ও প্রাথমিক সতর্কতাব্যবস্থা স্থাপনের জন্য অর্থায়ন হলে অনেক মানুষের জীবন হয়তো বাঁচানো সম্ভব ছিল।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চরম আবহাওয়ায় যখন এমন জলবায়ু-বিপর্যয়কর ঘটনাও বাড়ছে, ঠিক সেই সময়ে বহু দিনের পুরনো বা অকার্যকর অবকাঠামো প্রতিস্থাপনের জন্য জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রকল্পে অর্থায়নও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে বিশ্ব জুড়ে ঠিক যেখানে যেখানে এই অর্থ পৌঁছানো প্রয়োজন সেখানে এই অর্থ পৌঁছানোর কাজটি সহজ নয়।
আরও পড়ুন-
- চরম আবহাওয়ায় ১ দশকে বিশ্বে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি
- জলবায়ু সংকটের উদ্বেগ তুলে ধরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
- জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বজুড়ে খরাপ্রবণ এলাকা বেড়েছে ৩ গুণ
- জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কপ সংস্কারের দাবি বিশেষজ্ঞদের
- কমছে না জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণে নতুন রেকর্ড
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত জলবায়ু অর্থায়নের আওতায় যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, প্রথমত তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। দ্বিতীয়ত, এই বরাদ্দের বড় একটি অংশই সবচেয়ে বেশি জলবায়ু সংকটের মধ্যে থাকা অঞ্চলগুলোতে পৌঁছেনি।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) কোপেনহেগেন ক্লাইমেট সেন্টারের প্রভাব মূল্যায়ন ও অভিযোজন বিভাগের প্রধান হেনরি নেউফেল্ড বলেন, ‘যে পরিমাণ অর্থ আসছে তা পরিমাণে খুবই কম। পাশাপাশি যে অর্থ আসছে, তা খুব ভালোভাবে ব্যবহারও করা হচ্ছে না।’
জলবায়ু অর্থায়ন কোথায় হয়েছে?
বিশ্বব্যাপী ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রায় ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু-সম্পর্কিত প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়ন পর্যবেক্ষক সংস্থা ক্লাইমেট পলিসি ইনিশিয়েটিভ জানিয়েছে, এই পরিমাণ ২০১৯ সালে ব্যয়ের দ্বিগুণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকিতে বিনিয়োগ করা অর্থের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
ক্লাইমেট পলিসি ইনিশিয়েটিভের পর্যবেক্ষণ, জলবায়ু-সম্পর্কিত অর্থের বেশির ভাগই বিনিয়োগকারী দেশের অভ্যন্তরীণ প্রকল্পে ব্যয় হয়। এর একটি বড় অংশ শিল্পোন্নত দেশ ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে ব্যয় হয়েছে। অথচ এই অর্থ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর, যাদের নিজেদের অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রকল্প গ্রহণের সক্ষমতা নেই।
জলবায়ু অর্থায়ন সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে রয়েছে প্রশমন বা মিটিগেশন, যেমন— নবায়নযোগ্য শক্তির অবকাঠামো নির্মাণ, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে সহায়তা করে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশন, যা বন্যা প্রতিরোধের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক।
উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর উভয় ক্ষেত্রেই বেশি সহায়তা প্রয়োজন। ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোটের অর্থায়ন বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মাইকাই রবার্টসন বলেছেন, এই অঞ্চলগুলো জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন উভয়ের খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান চরম আবহাওয়া মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে।
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, তাপপ্রবাহ, ভারী বৃষ্টিপাত ও খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে দরিদ্র দেশই বেশি, যাদের বৈশ্বিক উষ্ণায়নে অবদান খুব কম। এসব দেশগুলোকে নামে ডাকা হয় গ্লোবাল সাউথ। ২০০৯ সালে গ্লোবাল নর্থ তথা শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা গ্লোবাল সাউথের দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করবে। ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি ছিল তাদের।
এই অর্থায়নের লক্ষ্য ছিল দরিদ্র দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা। যেমন— কোনো কোনো দেশ সমুদ্র প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে পারে। আবার কোনো দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কাজ করতে পারে। ভারী বৃষ্টিপাতের বিরুদ্ধে মজবুত অবকাঠামো তৈরিও কোনো কোনো দেশের জন্য বড় কাজ।
দেরিতে হলেও ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত পূরণ করা হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমাণও এখন অপ্রতুল মনে করছেন পরিবেশবিদরা। এবারের কপ২৯ সম্মেলনেও জলবায়ু অর্থায়নের এই বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। ইঙ্গিত রয়েছে, এবার অনুন্নত ও অনুন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বছরে দেড় ট্রিলিয়ন করে অর্থায়ন চাইতে পারে।
ন্যাচারাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নবিষয়ক সিনিয়র অ্যাডভোকেট জো থোয়েটস বলেন, ‘এই লক্ষ্য অর্জনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো এই অর্থ সঠিক সময়ে ও সহজ উপায়ে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাদের সত্যিই এটি প্রয়োজন।’
জলবায়ু অর্থায়নে প্রবেশাধিকার
এ পর্যন্ত জলবায়ু অর্থায়ন মূলত প্রকল্পভিত্তিক ছিল। দরিদ্র দেশগুলো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক বা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো নির্ধারিত সংস্থাগুলোর মাধ্যমেও আবেদন করা হয়ে থাকে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো, যেমন— স্বল্পোন্নত দেশ ও ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য অর্থায়নে প্রবেশাধিকার পাওয়া বিশেষভাবে কঠিন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে উচ্চ আয়ের দেশগুলোই মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন পায়।
অর্থায়নবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মাইকাই রবার্টসন ডয়েচে ভেলকে বলেন, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রক্রিয়া ও কর্মকৌশল তৈরি করেছে, তা বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর প্রয়োজন বিবেচনায় রেখেই করা হয়েছে, যেন এগুলো এসব দেশকে অর্থায়নে সহযোগিতা করে।
উদাহরণ দিয়ে রবার্টসন বলেন, ‘টুভ্যালুর জনসংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার। দেখা যাবে, হয়তো একটিই সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা এই সেবা দিতে সক্ষম… এ ধরনের বাস্তব পরিস্থিতিতে দেখা যায় যে প্রক্রিয়াগুলো ছোট দেশগুলোর জন্য বা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তৈরি নয়।’
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি তহবিল সম্পূর্ণ আলাদাভাবে পরিচালিত হয় এবং এর নিজস্ব নিয়মকানুন রয়েছে। ফলে আবেদন প্রক্রিয়ায় কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এর ফলে ছোট ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো, যাদের এমন দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার জন্য কম সম্পদ রয়েছে, তারা বাদ পড়ে যেতে পারে।
সহায়তাকারী সংস্থা ব্রেড ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের জলবায়ু নীতি উপদেষ্টা সাবিনে মিনিঙ্গার বলেন, ‘এটি একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। আপনি বলতে পারেন না যে তোমার দোষ তুমি দরিদ্র, তাই আমরা তোমাকে অর্থ দিতে পারব না। কারণ তোমার সেই অর্থ চাওয়ার সক্ষমতা নেই।
নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন
১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির অধীনে জলবায়ু অর্থায়নের বেশির ভাগই মিটিগেশন বা প্রশমনের জন্য বরাদ্দ। তবে স্বল্পোন্নত দেশ ও ছোট দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো অভিযোজনের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ পেয়ে থাকে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থের প্রায় অর্ধেকই অভিযোজনের জন্য ছিল। এর একটি বড় অংশ ছিল অনুদান আকারে, যা ফেরত দিতে হবে না।
২০২২ সালে অভিযোজনের জন্য বরাদ্দ অর্থ ছিল আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রতিশ্রুতির ২৮ বিলিয়ন ডলার। এটি ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ধারণা অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অভিযোজনের অর্থের বার্ষিক ঘাটতি রয়েছে ১৮৭ বিলিয়ন থেকে ৩৫৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে।
এদিকে যে অভিযোজন প্রকল্পগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে, সেগুলোর প্রায় অর্ধেককে অযৌক্তিক বা আরও অর্থায়ন না হলে স্থায়ীভাবে টেকসই হওয়া সম্ভব নয়।
বেসরকারি অর্থায়ন ব্যবহার করা
বেশির ভাগ জলবায়ু অর্থায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়তা করার জন্য ব্যয় হয়। তবে এই অর্থের অনেকটাই ঋণের আকারে আসে।
রবার্টসন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এটি একটি বিশাল সমস্যা, যার মুখে আমরা পড়ছি। একদিকে একে ১০০ বিলিয়ন ডলার হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে এই অর্থ আবার বরাদ্দ করা হচ্ছে ঋণ আকারে। অর্থাৎ এই অর্থ দাতা দেশের কাছেই ফেরত যাচ্ছে— সেটিও আবার সুদসহ। প্রকৃতপক্ষে তাহলে কে কাকে সহায়তা করছে?’
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু অর্থায়নের সুষম বণ্টন তথা সবচেয়ে প্রয়োজন যাদের তাদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্য ঋণসহ আর্থিক প্রক্রিয়ার একটি মিশ্রণ প্রয়োজন।
[ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন অবলম্বনে]
সারাবাংলা/টিআর
জলবায়ু অর্থায়ন জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন