সবাইকে স্বীকৃতি দিতে হবে— ‘জাতির জনক’ প্রসঙ্গে আমীর খসরু
১৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:২১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: এক ব্যক্তিকে ‘জাতির জনক’ হিসেবে স্বীকৃতির বিপক্ষে মত দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যাদের অবদান আছে, তাদের সবার স্বীকৃতি দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
শনিবার (১৬ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর ষোলশহরে বিপ্লব উদ্যানে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় যুবদল আয়োজিত সমাবেশে তিনি এ দাবি জানান। দিনব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে যুবদল বিকেলে সমাবেশের পর নগরীর চান্দগাঁওয়ে একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারকেন্দ্র ‘কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র’ অভিমুখে পদযাত্রা করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিপ্লব উদ্যানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘এই উদ্যানে দাঁড়িয়ে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করেছিলেন। এই বিপ্লব উদ্যানে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানিদের মুখের ওপর শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, আমি তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছি। সেই ঘোষণার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সাহেব বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। এই ঘোষণা দিয়েই তিনি সৈনিকদের নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমেছিলেন। এরপর কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে গিয়ে প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সুতরাং তিনি শুধু প্রথম মুক্তিযোদ্ধা নন, স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাও দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।’
নেতাকর্মীদের স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একথাগুলো আমাদের পরিষ্কারভাবে বলতে হবে, বুঝতে হবে ও জানাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। স্বাধীনতার এ কথাগুলো আজ অনেকে বলতে লজ্জা পায়, অনেকে বলতে সাহস করে না। কিন্তু আমাদের বলতে হবে- যে দুটি কাজের মাধ্যমে স্বাধীনতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন জিয়াউর রহমান, তার একটা হচ্ছে- এখানে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি রণাঙ্গনে নেমেছিলেন। আর দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা।’
‘সেই স্বাধীনতা ঘোষণার পর যাদের মধ্যে সন্দেহ ছিল, যারা কোনো নির্দেশনা পাচ্ছিলেন না, কারণ শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব তো পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দিয়ে পাকিস্তান চলে যান। বাংলাদেশের মানুষ তখন পথ খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশের মানুষকে পরিষ্কারভাবে পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তারপর পুরো জাতি যুদ্ধে নেমে যায়, সারা বাংলাদেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।’
‘ফাউন্ডিং ফাদারস’- প্রসঙ্গ টেনে আমীর খসরু বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা যখন আমরা বলি, এখানে কিন্তু অনেকের অবদান আছে, শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের অবদান- অন্যতম অবদান। আরও অনেকের অবদান আছে। এজন্য ফাউন্ডিং ফাদারস বলে একটা কথা আছে, জাতির জনক বলতে যা বোঝায়, এটা তো কোনো এক ব্যক্তির কথা নয়, এগুলোর পেছনে অনেক নেতার ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেক নেতাকে জীবনযুদ্ধে নামতে হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সাহেবসহ অনেকে সম্মুখযুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। অনেকের অনেক ভূমিকা আছে। সবাইকে স্বীকৃতি দিতে হবে।’
‘এজন্য আমেরিকাতে এদেরকে বলে ফাউন্ডিং ফাদার্স অর্থাৎ যার যার অবদান আছে সবাইকে, একাধিক ব্যক্তিকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আজ পর্যন্ত সবাইকে ওরা স্মরণ করে। কোনো একজন ব্যক্তি নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন ব্যক্তিকে সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশে যে খুন, গুম, হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, লুটপাট, বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, আইনের শাসন কেড়ে নেওয়া, বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করা, একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করা, সেই ব্যক্তির নাম দিয়ে, সেই ব্যক্তির মূর্তি স্থাপন করে সারা বাংলাদেশে, তারা এ খারাপ কাজগুলো করেছে। সেই স্বৈরাচারের যখন পতন হয়, যে ব্যক্তিকে ব্যবহার করে এ খারাপ কাজগুলো তারা করেছে, সেই ব্যক্তির মূর্তিগুলোও সব নেমে যায়। যে ব্যক্তিকে ব্যবহার করে এই খারাপ কাজগুলো করেছে, তাদের সাথে সাথে হঠাৎ করে সেই ব্যক্তিও যেন জনগণের কাছ থেকে চলে যায়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আপনি যখন কোনো সিম্বল ব্যবহার করে খারাপের পর খারাপ কাজ করতে থাকেন, আপনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সিম্বলেরও পতন হয়। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য, কারণ আমরা যদি সকলকে স্বীকৃতি দিতাম, আমরা যদি গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতাম, আমরা যদি দেশের মানুষের অধিকারগুলো দিতাম, ভোটাধিকার দিতাম, তাদের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার যদি ক্ষমতায় থাকতো, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতো, চরম দুর্নীতি, অর্থপাচার-এগুলো থেকে দেশটা বেঁচে যেত। সুতরাং স্বাধীনতাকে মূলধন করে, কোনো ব্যক্তিকে মূলধন করে কোনো খারাপ কাজ টিকে থাকতে পারে না। এটা বাংলাদেশে প্রমাণ হয়েছে।’
বিএনপি গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শহিদ জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল করেছিলেন। এটার মূল ভিত্তি বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জাতীয় ঐক্যের মাধমে, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, যেখানে জনগণ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এজন্য শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ দলকে ভাঙার জন্য, ধ্বংস করার জন্য হেন কিছু নেই, যা করা হয়নি। কিছুই বাকি ছিল না। বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আর গত ১৫ বছরে তো আমাদের নেতাকর্মীরা বাড়িঘরে থাকতে পারেনি, চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা হারিয়েছে, পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, আমাদের নেতাকর্মীরা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, গুম হয়েছে, খুন হয়েছে, আমাদের নেতাকর্মীরা বছরের পর বছর মিথ্যা মামলায় জেলখানায় কাটিয়েছে, আমিও কাটিয়েছি। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিএনপিকে ধ্বংস করে দেওয়া। তো, আজ বিএনপি কোথায় আর যারা বিএনপিকে ধ্বংস করতে গিয়েছিল, তারা কোথায়? আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি, অনেককিছু হারিয়েছি, জীবনের ভালো সময় হারিয়েছি, অনেক নেতাকর্মীকে আমরা হারিয়েছি। কিন্তু একটা ভালো কাজ হয়েছে- বিএনপির নেতাকর্মীরা জ্বলেপুড়ে খাঁটি সোনায় তৈরি হয়ে গেছে।’
বিএনপিকে থামানোর চেষ্টা করবেন না– এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আমীর খসরু বলেন, ‘বিএনপি আজ অনেকবেশি শক্তিশালী, আমাদের কেউ থামাতে পারবে না। বিএনপিকে যখন যারা থামাতে গেছে, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ একথা কেন বলছি? বিএনপিকে থামানোর চেষ্টা করবেন না। বাংলাদেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে তাদের সংসদ, তাদের সরকার দেখতে চায়। এটাকে বাধাগ্রস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি এজন্যই অতীতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। প্রয়োজনে আবারও ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা রাজি আছি।’
‘গণতন্ত্র কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কেউ বলে দিতে পারবে না যে, আগামীদিনে বাংলাদেশের রাজনীতি কী হবে। সেটা বলবে একমাত্র বাংলাদেশের জনগণ। সেটা আর কারও বলার কোনো সুযোগ নেই। এরকম বলার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকে চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব চেষ্টা করেছেন, পারেননি। এরশাদ এসে তার মতো ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল, পারেননি। শেখ হাসিনাও এসে নিজস্ব ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল, পারেননি।’
সুষ্পষ্টভাবে কোনোপক্ষের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাইকে বলব, বাংলাদেশের জনগণকেই তাদের ন্যারেটিভ তৈরি করতে দেন, তাদের সিদ্ধান্ত তাদের নিতে দেন। সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, এমন কোনো গোষ্ঠী, এমন কোনো শক্তি বাংলাদেশে এখনও তৈরি হয়নি। সেটা বাংলাদেশের জনগণকেই দিতে হবে। একমাত্র বাংলাদেশের জনগণই দিতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারেক রহমান সাহেব নিজেই জাতীয় সরকারের ঘোষণা দিয়েছেন। উনি বলেছেন, বিএনপি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও থাকেন, তারপরও জাতীয় সরকার করবো। কেন করবো ? কারণ, বাংলাদেশের মানুষের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে, আমরা বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি, আমরা কোনো বিভক্তি চাচ্ছি না। সেই জায়গা থেকে বিএনপি সরে যাবে না। বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচনের সময় জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে, পরবর্তী সময়ে জাতীয় সরকারের মাধ্যমে, সবাইকে নিয়ে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সেটা বাস্তবায়ন করবে।’
আমীর খসরু বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে যদি কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হয়, ঐক্যমতের ভিত্তিতে, আমি আবার রিপিট করছি, ঐক্যমতের ভিত্তিতে সেসব সংস্কার নির্বাচনের আগে হতে পারে, যেগুলো নেহায়েৎ প্রয়োজনীয়। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, আজ হবে, কাল হবে, পরবর্তী মাসে হবে, পরবর্তী বছর হবে, পাঁচবছর পর হবে, দশবছর পরও হবে। কেউ বসে বলতে পারবে না, আমরা বসে সংস্কার করে দিলাম। বাংলাদেশ আগামী ৫০ বছর এভাবে চলবে, এটা কেউ বলতে পারবে না। এভাবে চলে না, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।’
কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্নার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নয়নের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, নগর কমিটির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান এবং যুবদলের নগর কমিটির সাবেক সভাপতি মোশাররফ হোসেন দীপ্তি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেদ।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম