‘সড়কে নিহত সন্তানের মৃত্যু সনদ পেতেও ভোগান্তি’
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ২১:৫৬
ঢাকা: সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে লড়াকু সৈনিক ছিলেন আরিফুল ইসলাম আরিফ (৪০)। তার বন্ধু সৌভিক করিম অর্জুনও (৪২) ছিলেন একই রাজনৈতিক মতাদর্শের সহযোদ্ধা। যে রাজপথ তাদের আন্দোলনের ঠিকানা, সেখানেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাদের।
গত বছরের ৯ নভেম্বর মোটরসাইকেল চালিয়ে বাংলামোটর মোড় থেকে মগবাজারের দিকে যাচ্ছিলেন আরিফ। পেছনে ছিলেন অর্জুন। পথে ইস্কাটন রোডের ইস্টার্ন টাওয়ারের পাশে দুর্ঘটনার শিকার হন তারা।
সে রাতে ওই এলাকায় বাদাম বিক্রি করছিলেন মো. মামুন। তিনি বলেন, ‘রাত পৌনে ১২টার দিকে দেখতে পাই, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে গেছেন মোটরসাইকেলের দুই আরোহী। পরক্ষণে একটি ট্রাক দুজনকে চাপা দিয়ে চলে যায়। আশপাশের লোকজনসহ এগিয়ে গিয়ে দেখি, একজনের মাথা পুরোপুরি থেঁতলে গেছে। আরেকজন মাথার পাশাপাশি শরীরেও আঘাত পেয়েছিলেন। চাকায় পিষ্ট হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মৃত্যু হয়।’
আলোচিত এ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অর্জুনের মা রাজধানীর বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রওনাক করিম ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানালেন, সন্তানের মৃত্যুর পর মৃত্যু সনদ পেতে গিয়েও ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে তাকে। নিজের ভোগান্তি অভিজ্ঞতা থেকেই সংশ্লিষ্টদের প্রতি তার অনুরোধ, সড়কে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের পরিবার যেন প্রশাসনিক সহায়তাটুকু অন্তত পায়।
আরও পড়ুন-
- আরিফ-সৌভিককে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায়
- ইস্কাটনে ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল বাইক আরোহী ২ তরুণের
- ইস্কাটনে ট্রাকচাপায় নিহত দুজন গণসংহতি আন্দোলনের নেতা
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উদ্যোগে সড়কে হতাহতদের (রোড ট্রাফিক ভিকটিমস) স্মরণ ও ঢাকার সড়ক নিরাপদ করে তুলতে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক সভায় সড়কে নিহত আরিফের মা রওনাক করিম এ অনুরোধ জানান।
রোববার (১৭ নভেম্বর) সকালে নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে সড়কে হতাহতদের স্মরণে বৈশ্বিক দিবস ‘ওয়ার্ল্ড ডে অফ রিমেমব্রান্স ফর রোড ট্রাফিক ভিকটিমস’ উপলক্ষে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) ও ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের কারিগরি সহায়তায় এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য— ‘সেই দিন, যে দিনে রোড ক্র্যাশের কারণে পরিবারের সদস্য মারা গেছেন বা চিরতরে পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন।’
আরিফের স্ত্রী রেবেকা সুলতানা নীলাও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। পেশায় শিক্ষক নীলা বলেন, ‘এ মৃত্যু অবকাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলে আমি মনে করি। সড়কে ম্যানহোলের গর্ত ছিল, বিপরীত পাশ থেকে রিকশা আসছিল। ট্রাক অতিরিক্ত গতিতে আসছিল। এসব কারণে দুর্ঘটনা হয়, আর আমার স্বামীকে এত অল্প বয়সে প্রাণ হারাতে হয়। আমার শিশুসন্তান তার বাবাকে হারায়।’
হাতিরঝিলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত মুসাব্বির হোসেন (৩৮) তার দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, অতিরিক্ত গতির একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। তিনি স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট ব্যবহার করায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। তবে ১৭ ঘণ্টা তার জ্ঞান ছিল না। তিনি সবাইকে অতিরিক্ত গতি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলমের সভাপতিত্বে সভা সঞ্চালনা করেন বিআইজিআরএসের ইনিশিয়েটিভ কোঅর্ডিনেটর মো. আবদুল ওয়াদুদ। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের কারিগরি পরামর্শক আমিনুল ইসলাম সুজন।
সভাপতির বক্তব্যে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সড়কগুলোকে নিরাপদ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথোরিটিসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি। বিশেষত, ডিএনসিসি ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিসের বৈশ্বিক সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর আওতায় ঢাকা উত্তরের জনগণের জন্য নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
সভায় প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন বলেন, ‘যারা মারা যান, তাদের পরিবার যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায় তা খুবই হৃদয় বিদারক। যারা ভুক্তভোগী, শুধু তারাই এটি অনুধাবন করেন। ঢাকার সড়কে যারা মারা যান, তাদের বড় অংশ পথচারী এবং মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের আরোহী। পথচারীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রশস্ত ও সমান্তরাল ফুটপাথ নির্মাণ, জেব্রা ক্রসিং অঙ্কনসহ অবকাঠামোগত উন্নতি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয় ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
বিআইজিআরএসের ইনিশিয়েটিভ কোঅর্ডিনেটর মো. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘সড়কে হতাহতদের আন্তর্জাতিক দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সড়কে যারা মারা গেছেন ও পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন তাদের স্মরণ, নিহত ব্যক্তির পরিবার ও চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের জরুরি সেবা দেওয়া এবং সড়ক নিরাপদ করতে গবেষণাধর্মী তথ্য ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ।’
মূল প্রবন্ধে ভাইটাল স্ট্রাটেজিসের কারিগরি পরামর্শক আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আমরা সবাই সড়ক ব্যবহার করি। তাই সড়ক ব্যবহারে নিরাপত্তা বা নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের বিষয়টি সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।সড়ক দুর্ঘটনা একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। এটি সবাইকে প্রভাবিত করে। ঢাকা শহরের সড়কগুলো নিরাপদ করতে সড়ক ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সচেতনতা জরুরি। নিরাপদ গতিতে গাড়ি চালানো, জেব্রা ক্রসিং ও সিগান্যালে গাড়ি থামানো, সিট বেল্ট ব্যবহার, মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহারসহ বিদ্যমান আইন ও নীতি মেনে গাড়ি চালানোর বিষয়ে চালকদের সচেতন ও প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। বিশেষ করে, কৌশলগত প্রচারণা কর্মসূচির মাধ্যমে সব পর্যায়ের সড়ক ব্যবহারকারীকে সচেতন করা হলে সড়ক নিরাপদ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।’
ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) সিনিয়র রোড সেফটি স্পেশালিস্ট মো. মামুনুর রহমান বলেন, ‘ঢাকায় মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগ কমাতে ডিটিসিএ কাজ করছে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হলে পথচারীদের সড়ক পারাপার ও যানবাহনের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত হবে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক-ঢাকা উত্তর) সুফিয়ান আহমেদ বলেন, ‘সড়ক নিরাপদ করতে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও বিধিমালা ২০২২ অনুযায়ী পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার আলোকে ডিএমপি কাজ করে যাচ্ছে। সড়ক নিরাপদ করতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যানবাহনগুলো যদি আইন মেনে চলে তাহলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে।’
ডব্লিউআরআইয়ের টেকসই শহর কর্মসূচির পরামর্শক ফারজানা ইসলাম তমা বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়। কিন্ত নিরাপদ নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে যে এসব দুর্ঘটনার পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব, সেটি সংশ্লিষ্টদের জানা জরুরি।’
বিআইজিআরএসের সার্ভিল্যান্স কোঅর্ডিনেটর ডা. তানভীর ইবনে আলী বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা মহানগর পুলিশ, ভাইটাল স্ট্রাটেজিস, জনহপকিন্স সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ এবং সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও চট্টগ্রাম শহরে সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়ক ব্যবহারকারীদের আচরণ (সঠিক হেলমেট ব্যবহার, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ইত্যাদি) বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব তথ্য সড়ক নিরাপদ করতে নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (এনসিডি) ডা. ওয়াতিন আলম বলেন, ‘সড়কে কোনো দুর্ঘটনা হওয়ার পর দ্রুততার সঙ্গে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে অকালমৃত্যু ও পঙ্গুত্ব অনেক কমানো সম্ভব।’ এ ছাড়া দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় মানুষের সচেতনতা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম ফুটপাথ নকশা ও নগর পরিকল্পনা বিষয়ে আন্তর্জাতিক জ্ঞান ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করায় ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ও এর অংশীদার সংস্থাগুলোকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আগামী দিনে ঢাকার সড়ককে আরও নিরাপদ করতে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। একই সঙ্গে তিনি সড়কে স্বজন হারানো সব পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। বলেন, ‘যান্ত্রিক যানগুলো জেব্রা ক্রসিং ও সিগন্যালে সঠিকভাবে থামালে পথচারীদের সড়ক পারাপারে ঝুঁকি কমে আসবে।’
গোলটেবিল সভায় আরও বক্তব্য দেন ডিএনসিসি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, বিআইজিআরএসের ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেটর রেজাউর রহমান, ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক তামান্না মিজান, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) রোড সেফটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক কাজী বোরহান উদ্দিন, ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং) নাঈম রায়হান খান, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের অ্যাডভোকেসি অফিসার মো. মনোয়ারুল ইসলাম, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকল্প কর্মকর্তা মো. জুলহাস আহমেদ, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) সিনিয়র প্রজেক্ট ও কমিউনিকেশন অফিসার আবু রায়হানসহ অন্যরা।
সভায় উপস্থিত শিক্ষক রওনাক করিমের সন্তান সৌভিক অর্জুন ও রেবেকা সুলতানার স্বামী মো. আরিফুল ইসলামসহ ঢাকার সড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করার মাধ্যমে গোলটেবিল সভা শেষ হয়।
সারাবাংলা/এসবি/এইচআই
ডিএনসিসি রোড ক্র্যাশ রোড ট্রাফিক ভিকটিমস সড়ক দুর্ঘটনা সড়কে প্রাণহানি স্মরণ অনুষ্ঠান