সরকারের ১০০ দিন
স্থিতিশীলতা আসেনি প্রশাসনে, এখনো সচিব নেই ৪ মন্ত্রণালয়ে
১৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৩২
ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই অস্থিতিশীল প্রশাসন। নানা উদ্যোগ-প্রচেষ্টাতেও সেই প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হয়নি। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো, বদলি, ওএসডি, মামলার প্রক্রিয়া এখনো চলমান। এসব নিয়ে তাই প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখনো আতঙ্কে ভুগছেন।
এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ চার মন্ত্রণালয়ে এখনো সচিব দিতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আবার নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের কারও কারও প্রযুক্তি ও বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকায় কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না বলে পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এতে কাজকর্মে স্থবিরতা নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিন দিন পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
নতুন সরকার গঠনের পরপরই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ দেওয়া ১১ কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয় এক দিনে। এরপর থেকে শুরু হয় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল। কোনো কোনো কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে, কিছু কর্মকর্তাকে করা হয়েছে ওএসডি। অনেককে বদলি করা করা হয়েছে। এমনকি সকালে নিয়োগ দিয়ে বিকেলে তা বাতিলের মতো ঘটনাও ঘটেছে প্রশাসনে।
প্রশাসন সংস্কারের এ উদ্যোগে পরিবর্তন আনা হয় মাঠ প্রশাসনেও। জেলা প্রশাসক (ডিসি) ছাড়াও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও (ইউএনও) রদবদল হয় ব্যাপকভাবে। এর মধ্যে ডিসি নিয়োগের ‘কেলেঙ্কারি’ সারা দেশেই টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছিল।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত তিন মাসে সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ১২ জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া গ্রেড-১ পদে তিনজন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৫ জন, যুগ্ম সচিব পদে ২২৬ জন ও উপসচিব পদে ১২৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে পদোন্নতি দেওয়া হয় ৫০১ জন কর্মকর্তাকে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ১০১ কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে একই সময়ে। এর মধ্যে ৬৫ জন কর্মকর্তাকে নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ ১২ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা। বিটিআরসি, সিটি করপোরেশনেও চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তাদের।
দেশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদধারী আমলা হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদকেই দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। চানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তাকে ওএসডি করে। ২০১৬ সালে অতিরিক্ত সচিব পদে থেকে তিনি অবসরে যান। আট বছর অবসর কাটিয়ে সর্বোচ্চ পদ নিয়ে প্রশাসনে ফিরেছেন তিনি।
প্রশাসনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পদ জনপ্রশাসন সচিব মো. মোখলেস উর রহমানও নিয়োগ পেয়েছেন চুক্তিতে। বিসিএস-৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তাও ২০০৯ সাল থেকে ওএসডি ছিলেন, অবসরে যান শেখ আব্দুর রশীদের এক বছর আগে— ২০১৫ সালে। ৯ বছর পর আবারও প্রশাসনে ফিরে এসেছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, বাংলাদেশ পুলিশ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদেও দেওয়া হয়েছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক যেসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের কেউ কেউ আট বছর, এমনকি ১০ বছর আগেও অবসরে গেছেন। এসব কর্মকর্তাদের অনেকেই বর্তমান প্রযুক্তি ও কাজের ধরনের সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত নন। এমনও হচ্ছে যে তাদের কেউ কেউ যা নিজে বুঝতে পারছেন না, সেসব কাজ করার অনুমতিও দিচ্ছেন না। অর্থাৎ প্রযুক্তি ও বর্তমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না অনেকে। আর এ কারণে কাজে ধীরগতি রয়েছে।’
প্রশাসনে এত রদবদল হলেও এখনো সচিব পায়নি গুরুত্বপূর্ণ চার মন্ত্রণালয়। অক্টোবরের শুরুতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ
জামানকে ওএসডি করার পর থেকে ওই পদে কাউকে পদায়ন বা নিয়োগ দেওয়া হযনি। এ ছাড়া সচিব নেই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়
বিভাগ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার অনেক বড় মন্ত্রণালয়। গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মকর্তা না থাকলে কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। প্রায় দেড় হাজার জনপ্রতিনিধি গত ৫ আগস্টের পর পলাতক। কাজে গতি নেই ইউনিয়ন পরিষদে।’
প্রশাসনের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার নিয়ম মেনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতেই পারে। কিন্তু কাদের এবং কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’
আবদুল আউয়াল বলেন, ‘যারা চুক্তিতে নিয়োগ পাচ্ছেন তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বঞ্চিত ছিলেন। তখন পদোন্নতি পেলে হয়তো তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেতেন। এখন বর্তমান সরকার তাদের সে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু যদি সিস্টেমের সঙ্গে ম্যাচ না করে, তাহলে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এর প্রভাব পড়বে।’
অন্তবর্তী সরকারের এই প্রশাসনিক রদবদল নিয়ে নতুন করে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন অনেক কর্মকর্তারা। কিছুটা চাপা ক্ষোভও রয়েছে তাদের। জেলা প্রশাসক নিয়োগ ঘিরে কিছু কর্মকর্তার বিক্ষোভ তারই বহির্প্রকাশ। ‘বৈষম্যবিরোধী ক্যাডার’ ব্যনার নিয়ে আন্দোলনও করেছে প্রশাসনের আরও কয়েকটি ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
বৈষম্য নিরসনের দাবিতে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থাকা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারাও মৌন আন্দোলন করছেন। অনলাইন-অফলাইনে তারা আলোচনা সভা করছেন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের ব্যানারে।
আবার জনপ্রশাসনে দীর্ঘদিনের সুবিধাবঞ্চিতরাও দাবি নিয়ে সামনে এসেছেন। কোণঠাসা কর্মকর্তারা ভালো পদায়নের প্রত্যাশায় সিনিয়রদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে জনপ্রশাসন বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে কর্মকর্তাদের ভিড় লেগেই রয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রায় ডজনখানেক কর্মকর্তা সচিবালয়ে কাজে যোগ দেননি। এর মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি দফতর। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাজে যোগ না দেওয়ায় তারা আইন অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হবেন।
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
ওএসডি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রশাসন প্রশাসনে অস্থিরতা প্রশাসনে বদলি সরকারের ১০০ দিন