সবুজ-সোনারঙ ধানে কৃষকের মুখে হাসি, সঙ্গে অস্বস্তিও
১৯ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: হেমন্তের মিষ্টি ভোর। কুয়াশার চাদর ভেদ করে হাসছে সোনামুখী রোদ। সেই রোদ গিয়ে পড়েছে গুমাই বিলের দিগন্তজুড়ে মাথা উঁচু করে থাকা সবুজ, সোনারঙ ধানের শীষে। যত দূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ ক্ষেত যেন পাকা ধানের বিছানা! কৃষকের হাঁকডাক, ফসল কেটে গোলায় তোলার ব্যস্ততা। কাস্তে হাতে কেউ আবার গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে ‘ফসলের গান’।
চট্টগ্রামের শস্যভাণ্ডার খ্যাত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিক্ষেত ‘গুমাই বিলে’র চিত্র এখন এমনই। স্থানীয়দের মধ্যে প্রচলিত, এ বিলের এক মৌসুমের উৎপাদিত ধান দিয়ে সারা দেশের আড়াই দিনের খাদ্যের চাহিদা মেটানো যায়। তিন মাস আগে বন্যার সঙ্গে লড়াই করা গুমাই বিল এবারও কি সবসময়ের মতো কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে?
ধান কাটার মৌসুম মাত্রই কৃষকের মুখে হাসি, তবে অস্বস্তিও লুকাতে পারছেন না অনেকেই। অনেককেই বন্যার কারণে দুবার চারা রোপণ করতে হয়েছে। প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কৃষকের জমিতে ফলন কিছুটা কম। পুঁজি উঠবে কি না, এমন শঙ্কা কারও কারও। আর মৌসুমি কৃষি শ্রমিকরা ভুগছেন কম মজুরির হতাশায়। স্থানীয় বারোমাসি শ্রমিকরা অবশ্য তাতেই ‘পুষিয়ে নিচ্ছেন’।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলার নিশ্চিন্তাপুর পাহাড়ের পাদদেশে চন্দ্রঘোনা, মরিয়মনগর, হোসনাবাদ ও স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়ন এবং পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর আয়তনের এ গুমাই বিল। আর গুমাই বিল ঘিরে রয়েছে উইটাল্যা ও হরিণ্যা খালসহ কমপক্ষে পাঁচটি খাল। এসব খালের জোয়ার-ভাটার পানি আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে গুমাই বিলকে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এবার বিলের তিন হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে এবার ধানের সম্ভাব্য ফলন ধরা হয়েছে পাঁচ দশমিক তিন মেট্রিক টন। এ হিসাবে ধান হবে ১৬ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন। প্রতি টন ধানে ৬০০ কেজি করে চাল হিসাবে প্রতি হেক্টরে এবার চাল হবে প্রায় তিন দশমিক দুই টন করে। মোট চাল হবে ১০ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন।
নভেম্বরের শুরু থেকে গুমাই বিলে ধান কাটার ‘উৎসব’ শুরু হয়েছে। স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত তিন থেকে চার শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। এখনো ক্ষেতে কিছু ধান পুরোপুরি পাকেনি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ ও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ পুরোদমে ধান কাটা চলবে। এর মধ্য দিয়ে মৌসুমের ধান কাটা শেষ হবে।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস সারাবাংলাকে বলেন, ‘গুমাই বিলে এবার ফলন ভালো হয়েছে। এবার কৃষকরা ব্রি-৫১, ৫২, ৪৯, ৭৫ জাতের ধানের চাষ করেছে। এগুলোর উচ্চ ফলন হয়। সে বিবেচনায় আমরা হিসাব করেছি, প্রতি হেক্টরে পাঁচ দশমিক তিন মেট্রিক টন ফলন হবে।’
সোমবার (১৮ নভেম্বর) সকালে গুমাই বিলের কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার ফটো করেসপন্ডেন্ট শ্যামল নন্দীর। কৃষকদের মধ্যে ক্ষেতের মালিক যারা তারা বলছেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী এবার তারা ফলন পাননি। স্থানীয়দের হিসাব অনুযায়ী, অনেক জমির এক কানিতে (৪০ শতাংশ) ৫০ আড়ি (এক আড়িতে ১৬ সের বা কেজি) ধানও এবার হয়নি। এক কানিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার টাকা। বিক্রি করলে এক কানির ধানে আয় হবে ২০ হাজার টাকার মতো।
দেড় কানি জমি চাষ করেছেন আব্দুল খালেক। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ফলন কম হয়েছে। পানি উঠেছিল, সেটাতে আমরা ধরা খেয়েছি। পানির কারণে ফলন নষ্ট হয়েছে। তবে আল্লাহ গুমাই বিলে যা দিয়েছে, মোটামুটি হয়েছে। আশপাশের অন্যান্য বিলে সেটাও হয়নি।’
তিন কানি দুই গণ্ডা জমিতে আমন আবাদ করেছেন আবুল হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধান মোটামুটি হয়েছে। পানিতে ডুবে গিয়েছিল, পানি নেমে যাওয়ার পর আবার চারা লাগাতে হয়েছে। এ জন্য এবার খরচ বেশি হয়েছে। সাড়ে তিন কানিতে ৩২ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন ধান কেটে ঘরে নিতে খরচ আছে আরও ২০ হাজার টাকার মতো। তাহলে খরচ ৫২ হাজার টাকা। সাড়ে তিন কানি মিলে ধান পাব ১২০-১৩০ আড়ি। বিক্রি করলে ৬০ হাজার টাকার মতো পাব।’
‘ছোটবেলা থেকে গুমাই বিলে চাষবাস করছি। মাঝখানে সৌদি আরব ছিলাম ২৬ বছর। সৌদি থেকে এসে আবারও চাষবাসে নেমেছি। লাভ নাই, বাপেরদিন্যা পেশা বলে চাষবাস করি,’— বলেন আবুল হোসেন।
গত আগস্টের বন্যায় প্রায় তিন হাজার হেক্টরের গুমাই বিলের বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যায়। এতে সদ্য রোপণ করা ধানের চারা নষ্ট হয়ে যায়। তবে পানি নেমে যাওয়ার পর কৃষকরা আবার চারা রোপণ করেন।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেশকিছু জমি পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এতে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে পানি নেমে যাওয়ার পর আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নিই। যেসব কৃষকের জমি অক্ষত ছিল, তাদের রোপণ করা চারা পাতলা করে সেখান থেকে চারা সংগ্রহ করে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের সরবরাহ করি। তারা সেগুলো আবার রোপণ করেন। এ ছাড়া ব্রি-৫১, ৫২ জাতের ধানগুলো পানিসহিঞ্চু। এতেও ফসলের ক্ষতি কিছুটা কম হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনাও দিয়েছি।’
তবে ব্যাকটেরিয়া ও পোকার আক্রমণেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানালেন কয়েকজন। স্থানীয় কৃষকদের ভাষায়, ধান গজানোর শুরু থেকেই নানা ‘ব্যারামে’ ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গুমাই বিলের কৃষক আবু জাফর সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন পাতা বের হচ্ছিল, তখন একটা রোগ আসছিল। পাতা মরে লাল হয়ে গিয়েছিল, সাথে গুণগুণি ব্যারাম। শুরুতে স্প্রে করছিলাম। কিন্তু আগাতে ধান হয়নি। এবার এক কানিতে ধান ৫০ আড়ির বেশি হচ্ছে না। তিন কানি করেছি। অন্যবারের চেয়ে কানিতে ২০ আড়ি কম ধান পাচ্ছি। যেগুলো করছি, পুঁজি উঠবে না। অন্যবার এক কানি জমিতে ১৬ বস্তা ধান পেতাম, ২৫ কেজির বস্তা। এবার পেয়েছি ১৪ বস্তা।’
তবে কৃষক ওসমান গণি বেশ ভালো ফলন পেয়েছেন বলেই জানালেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধান ভালো হয়েছে। আমার আড়াই কানি আছে। এক কানিতে ১৩-১৪ হাজার টাকা করে খরচ যায়, ধান তোলা পর্যন্ত। আল্লাহর রহমতে ভালো হয়েছে। জমিতে এক জাতের ধান দুই-তিনবার চাষ করার পর সেটা চেঞ্জ করে অন্য জাত দিতে হয়। তাহলে ফলন ভালো হয়। যারা বলছেন ফলন ভালো হয়নি, সেটা নতুন জাতের ধান না দেওয়ার কারণে হয়েছে।’
চট্টগ্রামের বাইরের দূর-দূরান্তের জেলা থেকে প্রতিবছর শতাধিক কৃষিশ্রমিক যান গুমাই বিলে ধান কাটায় অংশ নিতে। এবারও শ্রমিকের হাট বসেছে সেই শস্যভাণ্ডারে। তবে পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি না পাওয়ার হতাশা অনেকের মধ্যে।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা থেকে যাওয়া কৃষিশ্রমিক মোহাম্মদ সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন বেতন দিচ্ছে দিনে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা গৃহস্থের (কৃষক)। ধান কম হচ্ছে, এটা বলে মজুরি কম দিচ্ছে। গত বছর আমরা ৮০০-১০০০ টাকা পেয়েছিলাম। অথচ এবার ধানের ফলন ওভার হয়েছে।’
আরেক কৃষিশ্রমিক রবি আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনো সব ধান পাকেনি। কামলার চাহিদা কম। কয়েকদিন পর একসাথে সব বিলে ধান কাটা শুরু হবে। তখন কামলার চাহিদা বাড়বে। তখন ৮০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি নেব।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর