‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২১ জন শিশুর মৃত্যু’
১৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৬
ঢাকা: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২১ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সংলাপ অনুষ্ঠানে এমন তথ্য জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ সভায় শিশু অধিকার নিয়ে কাজ এমন ১৪টি বেসরকারি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত কোয়ালিশনে অংশ নেয়।
এই কোয়ালিশনের উদ্যোগে বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতি ও করণীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ শীর্ষক আলোচনা সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের সমসাময়িক শিশু অধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে কোয়ালিশনের পর্যবেক্ষণ এমন তথ্য উঠে আসে।
এতে শিশু অধিকার রক্ষায় অগ্রগতি: প্রত্যাশা ও প্রতিবন্ধকতা চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ (CRAC,B) শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রজেক্ট অফিসার শান্তা ইসলাম।
সংলাপ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডস এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মাহমুদুল কবির, আসকের কোঅর্ডিনেটর তামান্না হক রিতি, এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন-এডুকোর শহীদুল ইসলামসহ আরও অনেকে।
কোয়ালিশনের লিখিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়-
বিগত বছরগুলোর ন্যায় ২০২৪ সাল জুড়েও, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ শিশুর প্রতি নানা সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত থেকেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাবমতে, এ সময়কালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, সহিংসতার কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে নিহত হয় মোট ৪৮২ জন শিশু। আর ২০২৩ সালের প্রথম দশ মাসে যা ছিল ৪২১ জন। এ ছাড়া ২০২৪ সালের প্রথম দশ মাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ৫৮০ জন শিশু, তবে, ২০২৩ সালের প্রথম দশ মাসে এ সংখ্যা ছিল ৯২০।
মূল প্রবন্ধে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ এ সময়কালে, বাংলাদেশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন সরকার আন্দোলন দমনে শক্তিপ্রয়োগ করে, ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায় এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করে কারফিউ জারী করে। আসকের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২১ জন শিশু মারা যায়। (শিশুর বয়সসীমা ১৮ বছর পর্যন্ত ধরে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়)
সংলাপ অনুষ্ঠানে শিশু অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোয়ালিশনের পক্ষ থেকে ২০ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান ও পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কোয়ালিশন এসব সুপারশিসমূহ সরকারের কাছে প্রস্তাব করে।
সেগুলো হলো:
১. জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ এবং জাতীয় শিশু নীতি ২০১১-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিশুর একটি অভিন্ন সংজ্ঞা এবং সবক্ষেত্রে শিশুর বয়স সুনির্দিষ্ট করতে প্রাসঙ্গিক আইনগুলো সংশোধন করা।
২. যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহত ও নিহত শিশুদের পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রকাশ করা।
৩. নিহতের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও আহত শিশুদের জন্য সুচিকিৎসা ও পূর্ণবাসন ব্যবস্থা করা।
৪. শিশুদের জন্য পৃথক অধিদফতর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা এবং দ্রুততার সাথে পৃথক শিশু অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা।
৫. শিশুদের সাথে প্রাক-বাজেট এবং বাজেট-পরবর্তী পরামর্শ সভার আয়োজন করা। আগামী অর্থবছর থেকে, পর্যায়ক্রমে শিশু-কেন্দ্রিক বাজেট ও প্রতিবেদন তৈরি এবং প্রকাশ করা।
৬. শিশু আইন বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী পরীবিক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে, শিশু সহায়তা ডেস্ক গঠন করা, প্রতিটি থানায় শিশুদের সহায়তার জন্য পৃথক পুলিশ অফিসার নিয়োগ করা।
৭. সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্টভাবে বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, আবাসিক প্রতিষ্ঠানসহ যে কোন কাঠামোতে শিশুদের উপর শারীরিক এবং অপমানজনক শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ করে শিশু আইন ২০১৩-এ একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা।
৮. শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
৯. ধর্ষণের সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণ করা, এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের যথাযথ সংশোধনের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া।
১০. অনলাইনে শিশু যৌন শোষণ রোধ করতে বিদ্যমান আইনগুলিতে; যেমন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২, শিশু আইন ২০১৩ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এ; সাইবার অপরাধের নতুন রূপগুলিকে সংজ্ঞায়িত এবং অন্তর্ভুক্ত করা।
১১. শিশু পাচার সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বিচার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সাতটি মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের কর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানো।
১২. শিশুদের মনস্তাত্তিক সমস্যা, আঘাত বা ব্যাধি কাটিয়ে উঠতে মনোসামাজিক সহায়তা (যেমন, কার্যকর কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি) নিশ্চিত করা।
১৩. বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে বাল্যবিয়েকে শুরুতেই বাতিল (Void ab Initio) ঘোষণা করে একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা, কেননা আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও এই বিয়েগুলি অবৈধ হয় না।
১৪. বাল্যবিয়ে নিরোধে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটিগুলোর কার্যক্রম জোরদার করা।
১৫. বাল্যবিয়ে নিরোধে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিকে ডিজিটালাইজেশন করা।
১৬. মানবাধিকারের মূলনীতিসমূহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি অভিন্ন এবং বৈষম্যহীন পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করা; তা জবাবদিহিতা এবং সকল শিশুর জন্য।
১৭. মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
১৮. গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ আইন প্রণয়ন করা এবং আইএলও কনভেনশন ১৮৯ অনুস্বাক্ষর করা।
১৯. আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের ঐচ্ছিক প্রোটোকল ৩ (যোগাযোগ প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের তৃতীয় প্রটোকল) অনুস্বাক্ষর করা এবং অনুসমর্থন করা।
২০. চতুর্থ পর্বের ইউপিআরে প্রাপ্ত শিশু অধিকার বিষয়ক সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য অংশীজনদের সাথে আলোচনাসাপক্ষে একটি সুনির্দষ্ট কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটি প্রদত্ত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যলোচনা করে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের আওতায় পিরিওডিক প্রতিবেদন প্রদান।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ (CRAC, B) বাংলাদেশে শিশু অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত অন্যতম একটি সক্রিয় জোট। যা ২০১৩ সাল থেকে কাজ করছে। জোটটি দেশের প্রথম সারির ১৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিশু অধিকার প্ল্যাটফর্ম, সংগঠন এবং ফোরামের সমন্বয়ে গঠিত। যার মধ্যে রয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যাসেম্বলি-উদ্দীপন (সচিবালয়), এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন-এডুকো, ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেভ দ্যা চিলড্রেন, শাপলা নীড়, এসওএস শিশু পল্লী, টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডস, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)- এর তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের প্রথম দশ মাসের (জানুয়ারি-অক্টোবর) শিশুর প্রতি সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রাপ্ত উপাত্ত বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ করে আপনাদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। আসকের এ সকল তথ্য ও উপাত্ত দেশের বহুল প্রচলিত ১০টি দৈনিক পত্রিকা ও গ্রহণযোগ্য অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং কিছুক্ষেত্রে নিজস্ব সূত্রমতে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে।
সারাবাংলা/কেআইএফ