সৌন্দর্যের ‘বলি’ পৌরসভার মাঠ, রাঙ্গামাটিতে উন্মুক্ত স্থান কমছে আরেকটি
২০ নভেম্বর ২০২৪ ১০:১০
রাঙ্গামাটি: পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার কারণে রাঙ্গামাটি শহরে নেই উল্লেখযোগ্য খোলা মাঠ। ক্রমবর্ধমান বসতির কারণে পাড়া-মহল্লার ছোট-বড় খালী বা উন্মুক্ত স্থানগুলোতেও গড়ে উঠেছে বড় বড় ইমারত ও বসতি। ক্রমান্বয়ে খোলা মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে ৪৭ শতাংশ ঘনত্বের শহর রাঙ্গামাটিতে।
এর বাইরে শহরে বড় সভা-সমাবেশ ও গণজমায়েতের উন্মুক্ত স্থান হিসেবে পরিচিত জেলা শহরের কুমার সুমিত রায় জিমনেসিয়াম ও পৌরসভা প্রাঙ্গণ। এবার পৌর কর্তৃপক্ষের সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগে আর খোলা থাকছে না পৌরসভা চত্বরটিও। বিশাল খোলা মাঠে ফুলের বাগান ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু করেছে প্রশাসকের দায়িত্ব চলা রাঙ্গামাটি পৌরসভা।
এদিকে পৌরসভার এ উদ্যোগের ফলে রাঙ্গামাটি শহর থেকে আরেকটি খোলা বা উন্মুক্ত মাঠ কমে যাওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, পাহাড়ি এলাকায় খেলাধুলা, সভা-সমাবেশ বা গণজমায়েতের জন্য পরিচিত রাঙ্গামাটি পৌর চত্বর ফুলের বাগানের নামে দখল করা হলে আরেকটি উন্মুক্ত স্থান কমবে রাঙ্গামাটির।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) বিকেলে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাঙ্গামাটি পৌরসভার নতুন কমপ্লেক্স ভবনের প্রবেশপথের দুই পাশে ফুলের বাগান সৃজনের জন্য মাটি খোঁড়া হয়েছে। পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মী (মালি) ও এক্সক্যাভেটর মেশিন দিয়ে খোঁড়াখুড়ির কাজ করা হয়েছে। খোঁড়াখুড়ি করা সেই মাঠের মধ্যেই ব্যাডমিন্টন খেলছিল শিশুরা।
রাঙ্গামাটি জেলা শহরে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশই কেবল নয়; বিজু, বৈসু, সাংগ্রাই উৎসবের অনুষ্ঠান বা আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের শোভাযাত্রা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক আয়োজনও হয়ে থাকে পৌরসভার এই উন্মুক্ত মাঠে। মাঠটি পৌরসভা কেবল নিজেদের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ব্যবহার করে নিলে সংকুচিত মাঠে আগের মতো আর আয়োজন সম্ভব হবে না মনে করছেন স্থানীয়রা। যদিও মাঠের কতটুকু অংশ নিয়ে ফুলের বাগান সৃজন করা হবে, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাচ্ছে না পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কেউ মুখ খুলছেন না।
জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যামল চন্দ্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কাটার কাজ চলছে। আমাদের পৌরসভার মালিরা কাজ করছেন। মোট মাঠের কতটুকু জমি জুড়ে বাগান সৃজন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হবে, এ নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি। তবে মাঠের যে অংশটুকুতে মাটি কাটা হয়েছে, সেই অংশেই বাগান করা হবে। এখনো কাজের বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়নি।’
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ১৮ আগস্ট দেশের পৌরসভাগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এতে রাঙ্গামাটি পৌরসভায় প্রশাসকের দায়িত্ব পান রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নাসরীন সুলতানা। পৌরসভায় নতুন প্রশাসক নিয়োগের পরই বাগান সৃজন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হচ্ছে।
জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি পৌরসভার সদ্য অপসারিত পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সময়ে পৌর মাঠে বাগান সৃজনের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তবে নতুন কমপ্লেক্স পাশ করে একটি মিলনায়তন করার পরিকল্পনা আছে মাস্টারপ্ল্যানে। আর এই অংশটুকু খালি রাখার পরিকল্পনাই ছিল, যেখানে গাড়ি পার্কিং করা যায়।’
সাবেক এই মেয়র আর বলেন, ‘পৌরসভার আশপাশের পাড়ার বাচ্চাদের খেলাধুলা ছাড়াও এই মাঠে বিভিন্ন বড় সভা-সমাবেশ হয়ে থাকে। এখন মাঠে এমন উদ্যোগ নেওয়া হলে সভা-সমাবেশ ও খেলাধুলার সুযোগ থাকবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগের পক্ষে না।’
ক্রীড়া সংগঠক ও খেলাঘর আসর রাঙ্গামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক সৈকত রঞ্জন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফুলের বাগান হয়তো পৌরসভার সৌন্দর্য বাড়াবে, তবে উন্মুক্ত স্থান ধ্বংস করার ফলে অসুস্থ শহরে পরিণত হবে রাঙ্গামাটি। পৌরসভার জন্য নাগরিক নয়, নাগরিকদের জন্য পৌরসভা। একটি মডেল পৌরসভার জন্য পরিকল্পনামাফিক উন্মুক্ত স্থান থাকা জরুরি। নানা অনুষ্ঠানের জন্য স্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পৌরসভার খোলা জায়গা নষ্ট করে অন্য স্থাপনা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জায়গা উন্মুক্ত রেখেই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের অনুরোধ করছি পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে।’
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙ্গামাটি জেলার সভাপতি মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাঙ্গামাটি শহরের মধ্যে গণজমায়েত, বিভিন্ন মেলা, শিশুদের খেলাধুলা ইত্যাদি নাগরিক সুবিধার জন্য খোলা মাঠ নেই বললেই চলে। পৌরসভার খোলা মাঠটি এতদিন এসব কাজে চমৎকারভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে নাগরিক সুবিধাগুলো আরও সংকুচিত হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ সব সুবিধা পাওয়ার জন্য তো আমরা পৌরসভাকে কর দিই। পর্যটন শহর হিসেবে আমরা সৌন্দর্যবর্ধনকে উৎসাহিতও করি। কিন্তু সেটা যেন বর্তমান খোলা মাঠের আকারকে যেন কোনোভাবেই সঙ্কুচিত করে করা না হয়, সেই দাবি জানাচ্ছি। নাগরিক সুবিধা ও অধিকার বজায় রাখার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষকে জোরালো অনুরোধ করছি।’
জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি পৌরসভার প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নাসরীন সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পৌরসভার গত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, পৌরসভার খালি মাঠের সৌন্দর্যবর্ধন ও একে সুরক্ষিত করা হবে। দীর্ঘদিন ধরেই মাঠটি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এখন নতুন পৌর কমপ্লেক্সে প্রবেশ পথের দুই পাশে সৌন্দর্যবর্ধন কাজ ও লাইটিংয়ের ব্যবস্থা হবে। এ ছাড়া বাউন্ডারি ওয়ালসহ আরও কিছু কাজ রয়েছে। সেগুলোর জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পৌরসভার মাঠ তো পৌরসভার নিজস্ব জায়গা। সেখানে তারা সৌন্দর্যবর্ধন করবে নাকি অন্য কোনো কাজ করবে, সেটা পৌরসভার নিজস্ব ব্যাপার। কেউ যদি তার জমিতে কিছু করতে চান, প্রশাসন তো না করতে পারে না। আর আগে রাজনৈতিক নেতারা দায়িত্বে (জনপ্রতিনিধি) ছিলেন, এখন তো তারা নেই। মানুষ পৌরসভায় সেবা নিতে আসবেন, সেখানে রাজনৈতিক সভা চললে হয় না।’
সারাবাংলা/টিআর
খেলার মাঠ পৌরসভা মাঠ রাঙ্গামাটি রাঙ্গামাটি পৌরসভা সৌন্দর্যবর্ধন