Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন- রেড ক্রিসেন্ট অর্থোপেডিক পুনর্বাসন কেন্দ্র। ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাইরে থেকে দেখলেই মনে হবে একটি সুন্দর, পরিপাটি, আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই অন্য চিত্র। চারতলা ভবনটির শুধুমাত্র একটি ফ্লোরের তিনটি কক্ষে দেওয়া হয় চিকিৎসা, সেখানে রোগীর সংখ্যাও নামমাত্র।

নগরীর কোতোয়ালি থানার বিআরটিসি এলাকায় ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন- রেড ক্রিসেন্ট অর্থোপেডিক পুনর্বাসন কেন্দ্র’ নামে বিশেষায়িত এ হাসপাতালে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে । হাসপাতালের নামের আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা সেটার কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছুই জানেন না। বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি নিয়ে অন্ধকারে আছেন বলেও জানিয়েছেন চসিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

চসিকের কর্মকর্তারা জানান, চুক্তির মাধ্যমে ভবনটি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে নামমাত্র মূল্যে ভাড়া দেয় চসিক। চুক্তি অনুযায়ী রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চার তলা বিশিষ্ট ওই ভবনজুড়েই হাড়-পেশিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়ার কথা। এর পর সেখানে অর্থোপেডিক পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হলেও সিটি করপোরেশনকে অবহিত করা হয়নি। এমনকি চসিকের পক্ষ থেকেও তেমন খোঁজ নেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ আগস্ট চসিক ও রেড ক্রিসেন্টের যৌথ উদ্যেগে ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ফিজিও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন সেবাকেন্দ্রটি চালু হয়। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কোষাধাক্ষ্য মোহাম্মদ আবদুস সালামের ব্যক্তিগত অর্থায়নেই ফিজিও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন সেবা কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়।

এর আগে, ভবনটি স্থানীয় বিভিন্ন ফুটবল লিগে চসিক থেকে অংশগ্রহণ করা খেলোয়াড়দের বিশ্রামগার হিসেবে ব্যবহার হতো। পরে সেটাকে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল। শেষমেশ বাৎসরিক মাত্র ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে চসিকের কাছ থেকে ভবনটি ভাড়া নেয় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, চারতলা বিশিষ্ট ভবনের নিচতলার বামপাশে হাসপাতালে ওঠার সিঁড়ি। তার পাশেই শাটারলাগানো দু’টি দোকান। যেগুলো দিনের বেলায় বন্ধ থাকলেও রাতে পরিবহন শ্রমিকরা বিশ্রাম নিতে আসেন। এর পাশেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালনা করা একটি পাবলিক টয়লেট। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই দেখা মেলে হাসপাতালের রিসিপশন কক্ষ। তবে রিসিপশনে কাউকে দেখা যায়নি। তার পাশের কক্ষে একজন ফিজিও থেরাপিস্ট বসে আছেন চেয়ারে। রোগীর বেডে শুয়ে আছেন ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর।

দোতলায় মোট তিনটি কক্ষে রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনতলায় রেড ক্রিসেন্টের ত্রাণের কাজে ব্যবহার করা কিছু জিনিসপত্রও দেখা যায়। ওই মেঝেতে অফিস কক্ষ ও ডাক্তারের রুম লেখা থাকলেও সেগুলো বন্ধ ছিল। চতুর্থ তলায় একটি কনফারেন্স রুম আছে, যেটা যুব রেড ক্রিসেন্ট তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে ব্যবহার করে বলে জানা গেছে।

চারতলা ভবনটির শুধুমাত্র একটি ফ্লোরের তিনটি কক্ষে দেওয়া হয় চিকিৎসা। ছবি: সারাবাংলা

চারতলা ভবনটির শুধুমাত্র একটি ফ্লোরের তিনটি কক্ষে দেওয়া হয় চিকিৎসা। ছবি: সারাবাংলা

ফিজিও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে এখন তিন জন ফিজিও থেরাপিস্ট নিয়মিত সেবা দেন। প্রতিষ্ঠানটিতে একজন সহকারী ও আরেকজন প্রহরীও দায়িত্বে আছেন। তাদের বেতনের পুরোটা অংশ আসে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ আবদুস সালামের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে। দৈনিক তিন থেকে চারজন রোগী সেখানে যান। প্রথমদিন কেউ সেবা নিতে এলে ২৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। এর পর থেকে ১৮০ টাকা দিয়েই হাসপাতালটির সেবা নেওয়া যায়।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের অভিযোগ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হলেও এর বিষয়ে মানুষ এখনও জানে না। যদি ভালো করে প্রচার করা হতো তাহলে এখানে রোগীর চাপ বাড়তো। রোগী না থাকলে হাসপাতালে লোকবল বাড়িয়ে লাভ নেই। প্রচারের ঘাটতির ফলে হাসপাতালটি লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। এছাড়া, যে ঠিকাদারকে হাসপাতালটির যন্ত্রাংশ ও জিনিসপত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তিনি সেসব নিম্নমানের দিয়েছেন। রোগীদের শোয়ার বেডগুলোও খুবই নিম্নমানের।

চসিক-রেড ক্রিসেন্ট অর্থোপেডিক পুনর্বাসন কেন্দ্রের ফিজিওথেরাপিস্ট ইসমে আজিম আসিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এখানে নিয়মিত ডিউটি করি। কিন্তু আশানুরূপ রোগী এখানে আসে না। কারণ, চট্টগ্রামের ৯৯ শতাংশ বাসিন্দাই জানেন না এরকম একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল এখানে আছে। প্রতিষ্ঠার এক বছর হলেও এটা নিয়ে তেমন প্রচারও নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজে বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদের এ বিশেষায়িত হাসপাতাল সম্পর্কে ব্রিফ দিয়ে আসি। উনারা যাতে আমাদের এখানে রোগী পাঠান। কিন্তু কিছু পেতে হলে তো কিছু দিতে হয়। সেটা তো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর এটা তো আমার কাজ না। তবুও আমি যাতে মানুষ কম টাকায় ভালো চিকিৎসা পায় সেজন্য এ চেষ্টাটা করি। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যদি আশানুরূপ ব্যবস্থা না নেয় তাহলে কিছুদিন পর এ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব থাকবে না।’

প্রথমদিন কেউ সেবা নিতে এলে ২৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। এর পর থেকে ১৮০ টাকা দিয়েই সেবা নেওয়া যায়। ছবি: সারাবাংলা

প্রথমদিন কেউ সেবা নিতে এলে ২৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। এর পর থেকে ১৮০ টাকা দিয়েই সেবা নেওয়া যায়। ছবি: সারাবাংলা

চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা সিটি করপোরেশনের স্থাপনা হলেও ওখানকার বেতন থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করছে রেড ক্রিসেন্টের সালাম সাহেব। সেজন্য এটা নিয়ে আমরা তেমন কিছু জানি না। এখন উনি যদি সেটা চালাতে না পারেন তাহলে স্থাপনাটি আমাদের বুঝে নিতে হবে। এটা স্বাস্থ্য বিভাগের কন্ট্রোলেও নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমি নিজে কয়েকবার ঘুরে আসছি। থেরাপিও নিয়েছি। ওখানে একজন কনসালটেন্ট আসেন নিয়মিত। এখন যেহেতু ভবনটি আমাদের, সেহেতু সেটা নিয়ে আমি মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলব। আর মেয়র মহোদয় নিজেই যেহেতু একজন অর্থোপেডিক ডাক্তার, সেহেতু তিনি এ বিষয়ে জানলে হয়তো প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করার চিন্তা করবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি আজই এ বিষয়ে উনাকে বলব। এখন পর্যন্ত উনাকে হাসপাতাল সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়নি। তাই উনি এটার সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না।’

নামে হাসপাতাল, কাজে ‘রেড ক্রিসেন্ট’ অফিস

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওই ভবনকে হাসপাতাল করার নাম ভাঙিয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি তার অফিশিয়াল কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালনা করে। এমনকি ভবনটির চতুর্থ তলায় যুব রেড ক্রিসেন্টের সিটি ইউনিট কার্যক্রম চালায়।

চট্টগ্রাম সিটি ইউনিট রেড ক্রিসেন্টের ইউনিট লেভেল কর্মকর্তা আবদুর রহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চারতলায় একটি কনফারেন্স রুম আছে, যেটা যুব রেড ক্রিসেন্ট ব্যবহার করে। আমাদের চট্টগ্রামের ৪১ ওয়ার্ডে রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রম আছে। চট্টগ্রামের প্রায়ই সব স্কুলেও আমাদের কার্যক্রম আছে। এখান থেকেই ওসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে এখন তেমন রোগী আসে না। তাই আমাদের আর লোকবল দরকার নেই। রোগী বাড়লে লোকবল বাড়ানো হবে। এখন রোগী আসে চার থেকে পাঁচ জন। আমরা প্রচারের চেষ্টা করছি। এটার বয়স মাত্র একবছর। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এটা একদিন ভালো জায়গায় যাবে।’

‘অন্ধকারে’ চসিক

নগরীর বিআরটিসিতে ফিজিও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন সেবাকেন্দ্রটির নামের আগে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের নাম থাকলেও হাসপাতালটির বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন খোদ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

চসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমাম হোসেন রানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আসলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কখন কীভাবে করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ কিছুই জানে না। উদ্বোধন হওয়ার পর সেটা নিয়ে জানতে পারি। ওই হাসপাতাল নিয়ে এখনও আমরা অন্ধকারে আছি। তবে আমি যেতে না পারলেও মাঝে মাঝে আমাদের একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ওখানে ভিজিট করে আসেন।’

চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালটিতে আমি একবার গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছি। তবে এটি সম্পর্কে আমার বিস্তারিত জানা নেই। স্বাস্থ্য বিভাগও এ বিষয়ে তেমন ওয়াকিবহাল না।’

ফিজিও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন সেবাকেন্দ্রের নিচতলার বামপাশে একটি টয়লেট রয়েছে। যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি হাসাপাতাল না কি গণশৌচাগার। ছবি: সারাবাংলা।

ফিজিও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন সেবাকেন্দ্রের নিচতলার বামপাশে একটি টয়লেট রয়েছে। যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি হাসাপাতাল না কি গণশৌচাগার। ছবি: সারাবাংলা।

হাসপাতাল নাকি শৌচাগার বোঝা দায়!

ফিজিও অর্থোপেডিক পুনর্বাসন সেবাকেন্দ্র হওয়ার আগে ভবনটির নিচতলার বামপাশে একটি টয়লেট থাকলেও হাসপাতাল উদ্বোধনের সময় সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতাল উদ্বোধনের পর ডানপাশে ফের ব্যক্তি উদ্যোগে একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়। ফলে হাসপাতালের আশেপাশে পরিবেশের সৌন্দর্য বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার কর্মকর্তারা।

হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, সিটি রেড ক্রিসেন্টের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জব্বার শৌচাগারটি তত্ত্বাবধান করছেন। শৌচাগারের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীও বিষয়টি সারাবাংলার প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওখানে শুধু সিটি করপোরেশনের নামটি আছে। তবে তেমন কোনো তত্ত্বাবধান হয় না। বিল্ডিংয়ের পাশে একটি টয়লেট ছিল। উদ্বোধনের সময় সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন শুনছি আবার টয়লেটটি চালু করা হয়েছে। জব্বার নামে যিনি টয়লেটটি পরিচালনা করছেন তার নামে ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগ আছে।’

জানতে চাইলে সিটি রেড ক্রিসেন্টের ইউনিটের লেভেল কর্মকর্তা আবদুর রহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি শুধু দোতলা আর তিনতলার বিষয়টি জানি। সিটি করপোরেশন নিচেরটা এখনও তত্ত্বাবধান করছে। এটা জব্বার ভাই বলতে পারবেন। তিনিই তখন বিষয়গুলো দেখভাল করেছিলেন।’

সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম

চসিক নাম হাসপাতাল

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর