প্রধান সড়কে অটোরিকশা ‘আত্মঘাতী’, অলিগলিতে চলাচলের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ০০:১৭
ঢাকা: বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল থেকে বাংলাদেশ সচিবালয় কিংবা জাতীয় প্রেসক্লাবের দূরত্ব যতই হোক, রিকশা ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই ভাড়া হয়ে যায় দ্বিগুণ। তবে এই হিসাব প্যাডেলে চালিত রিকশার। একই দূরত্বে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা। দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি মেনে নিয়েও দ্রুত গতি আর কম ভাড়ার কারণে যাত্রীরাও ব্যাটারিচালিত রিকশাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।
গত কয়েক বছরে এ রকম অটোরিকশাই শহর থেকে গ্রামের সড়ক দখল করে নিয়েছে। নগর পরিকল্পনা আর যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বরাবরই প্রধান সড়কে ছোট যানবাহনের বিপক্ষে থাকলেও ঢাকা মহানগরীতেও এসব অটোরিকশা জায়গা করে নিয়েছে সময়ের ব্যবধানে। এরপর সরকার চেয়েও রাজপথ থেকে অটোরিকশা উচ্ছেদ করতে পারেনি। এবার উচ্চ আদালত থেকেও একই সিদ্ধান্ত এসেছে। সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফের লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়েছেন রিকশাচালকরা। তাদের দিনভর বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়েছিল রাজধানী ঢাকা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল রেলপথও।
রিকশাচালকরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের জীবিকা বিবেচনা করার কথা বলেছেন। যাত্রীসহ সর্বসাধারণের মধ্যে রয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ছোট যানবাহন শুধু দুর্ঘটনার কারণই নয়, যানজটেরও বড় কারণ। বিগত সরকারের এ ধরনের গাড়ি প্রধান সড়কে চলার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতী। এখন অটোরিকশার ব্যবহার একেবারে বন্ধ করা না গেলেও একে অলিগলিতে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, প্রধান সড়কে উঠতে দেওয়া যাবে না।
হিসাব নেই অটোরিকশার
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে গত অক্টোবর পর্যন্ত যেসব গাড়ির নিবন্ধন রয়েছে তার সংখ্যা ৬২ লাখ। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা ৮৪ হাজার। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও অটোটেম্পুর সংখ্যা তিন লাখ ৪২ হাজার। এর বাইরে তিন চাকার ছোট যানবাহন চলাচল করে ৬০ থেকে ৭০ লাখ। তবে সারা দেশে বা রাজধানীতে ঠিক কতগুলো তিন চাকার গাড়ি চলাচল করে, তার সঠিক হিসাব কোথাও পাওয়া যায় না।
এ পরিস্থিতিতে দেশে বা ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যারও কোনো হিসাব নেই। তবে যানবাহন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর ধারণা, যে কয় লাখ তিন চাকার গাড়ি চলাচল করে এর মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা হতে পারে ১৫ লাখ।
বন্ধ করতে গিয়ে মূল সড়কে অটোরিকশা
এ ধরনের যানবাহন চলাচলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ও যানজট কমাতে গত মে মাসে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছিল। ওই বৈঠক থেকে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সে সিদ্ধান্তের খবরে আগারগাঁও-মিরপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, ভাঙচুর চালান চালকরা। পরে ওই মাসেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্বল্প আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিবহণ খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ওই সিদ্ধান্তের পরপরই ব্যাটারিচালিত রিকশা স্রোতের মতো মূল সড়কে বেরিয়ে আসে। গত কয়েক মাসে তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ছেয়ে যায় ঢাকা শহর। রাজধানীর জনাকীর্ণ যেকোনো স্থান তো বটেই, বিশেষ করে মেট্রোরেলের প্রবেশ ও প্রস্থানের পথগুলোতে সারি সারি এসব অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য এখন নিয়মিত। এমনকি বাস স্টপেজগুলোতেও এসব অটোরিকশা ভিড় করে করে থাকে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর বিক্ষোভ
এমন অবস্থার মধ্যেই মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের আদেশ দেন হাইকোর্ট। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন।
উচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্তের খবরে পরদিন বুধবার দয়াগঞ্জ মোড়সহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে আন্দোলনে নামেন চালকরা। সে আন্দোলন বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সকাল থেকে ব্যাপক আকার ধারণ করে।
মহাখালী, আগারগাঁও, মিরপুর, গাবতলী, দারুস সালামসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন চালকরা। স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা। মহাখালী রেল ক্রসিং অবরোধ করায় সারা দেশের সঙ্গে ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর বিকশাচালকরা সড়ক ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।
যাত্রীদের কাছে অটোরিকশা কেমন
হঠাৎ করে রিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ায় বিপদে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও যানবাহন পাচ্ছিলেন না তারা। স্বল্প দূরত্বে চলাচল করা এ সব যাত্রীদের মধ্যেও অটোরিকশা চলাচলের পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে মিশ্র মতামত।
রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বর এলাকায় বৃহস্পতিবার বিকেলে কথা হয় ব্যাংক কর্মকর্তা সজিব আহমেদের সঙ্গে। বাসা সাগুফতা হাউজিং থেকে মিরপুর-১১ নম্বরে তার যাতায়াতের বাহন অটোরিকশা, ভাড়া ৩০ টাকা।
সজিব আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, রিকশাচালকদের আন্দোলনের কারণে সকাল থেকে এখানে কোনো গাড়ি নেই। আসার সময় বাসে করে এলেও ফেরার পথে হেঁটেই যেতে হচ্ছে। এভাবে হঠাৎ করে রিকশাগুলো তুলে দেওয়া উচিত হয়নি।
একই কথা বলেছেন মেট্রোরেল স্টেশনে যানবাহনের অপেক্ষায় থাকা যাত্রী আফসানা যুথী। তিনি বলেন, ‘বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যাব কালশি মোড়। এখান থেকে রিকশা ভাড়া ২০ টাকা। অথচ কয়েকটা রিকশা এলো-গেল, ৪০ টাকার নিচে যাবে না।’
মতিঝিল মেট্রো স্টেশনের কাছেও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তারাও বিকল্প ব্যবস্থা না করে এভাবে অটোরিকশা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ সব স্থানে রিকশার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে যাত্রীদের। অনেকে পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছেন।
আতিকুর রহমান নামে এক যাত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশার পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বললেন, ‘প্যাডেলে চালিত রিকশায় চালকের যে কায়িক শ্রম, তা এই সময়ের সঙ্গে কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলনামূলকভাবে দ্রুতগতিতে যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। প্যাডেলে চালিত রিকশার তুলনায় ভাড়াও কম। যদি মনে হয় এটি ঝুঁকিপূর্ণ, তাহলে সরকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলুক। কীভাবে এই ঝুঁকি কমানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করুক। বিশেষজ্ঞদের অনেককেও তো দেখি অটোরিকশার ঝুঁকি কমানোর নানা সমাধান নিয়ে কথা বলছেন। সেগুলো নিয়ে সরকার কাজ করুক।’
তবে অটোরিকশা তুলে দেওয়া পক্ষেও মতামত দিয়েছেন অনেকে। এর পেছনে তাদের সবারই বিবেচনা একটিই— দুর্ঘটনার ঝুঁকি। তাদেরই একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। এ রকম দুই রিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন তিনি।
মতিঝিলে এলাকায় কথা হচ্ছিল শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই রিকশাগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একবার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পায়ে ব্যথা পেয়ে সাত দিন বেড রেস্টে থাকতে হয়েছে। এসব রিকশা তুলে দেওয়াই উচিত।’
পাঠাও চালক ইব্রাহিম বলেন, ‘এরা কোনো নিয়ম মানে না। এদের কারণেই সড়কে যত্রতত্র যানজট তৈরি হয়।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অটোরিকশা রাজধানী চলতে না দেওয়ার পক্ষে অভিমত জানিয়েছেন অনেকেই। পাশাপাশি বৃহস্পতিবার দিনভর রাজধানী অচল করে রিকশাচালকদের আন্দোলনে ভোগান্তির শিকার হওয়ার কথাও ছিল।
গণমাধ্যম কর্মী সঞ্চিতা সীতু লিখেছেন, ‘কোনো ছুতা বের করে রাস্তায় নেমে যাচ্ছে একদল। আর সেনাবাহিনী এসে ওদের সরাচ্ছে। কী একটা কাজ! প্রতিদিনই এক সিনেমা। মাঝে ভোগান্তি আমাদের মতো মানুষের।’
সাইফুল্লাহ তামিম ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, ‘এলাকার অলিগলিতে অটোরিকশা চলতে পারে, কিন্তু মহাসড়কে কোনোভাবেই চলতে দেওয়া উচিত হবে না। এদের গতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। রাস্তা পার হওয়ার সময় এদের নিয়ে সবচেয়ে ভয়ে থাকতে হয়।’ তার এ মন্তব্যে সায় দিয়েছেন ৬৯১ জন।
তবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পক্ষে অবস্থান নিয়ে আকতার হোসেন নামে আরেকজন লিখেছেন, ‘মানুষ দিয়ে মানুষ টানার কঠোর ও অমানবিক দৃশ্য আর দেখতে চাই না। ব্যাটারিচালিত রিকশার পক্ষে সবসময় ছিলাম, এখনো আছি।’ তার স্ট্যাটাসের পক্ষেও সায় দিয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। তবে মন্তব্যের ঘরে বেশির ভাগেরই অভিমত ব্যাটারিচালিত রিকশা অলিগলিতে চলার অনুমতির পক্ষে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
শুধু দুর্ঘটনাই নয়, ছোট ছোট যানবাহনকে যানজটেরও প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যারাই আসুক না কেন, তারা শহরের রাস্তাগুলো ছোট ছোট গাড়ির জন্য ছেড়ে দেন। এতে গণপরিবহণ উপেক্ষিত হয়। বাসের ৫০ জন যাত্রী যখন দেখেন যে গাড়িটি ধীরগতিতে চলছে, তখন নেমে ছোট গাড়িতে চলে যান। এ রকম হলে শহর থেকে কোনোদিন যানজট যাবে না।’
ছোট গাড়ির আধিক্যকেই যানজটের মূল কারণ হিসেবে অভিহিত করছেন অধ্যাপক শামসুল। তারও অভিমত, পাইলটিংয়ের মাধ্যমে শাখা সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করতে দেওয়া যেতে পারে, কোনোভাবেই প্রধান সড়কে নয়। এ ক্ষেত্রে তিনি গুলশান, বনানী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার উদাহরণও তুলে ধরেন। এসব এলাকায় সুনির্দিষ্ট সড়কে নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে রিকশা চলাচল করে থাকে।
শামসুল হক বলেন, ‘গণপরিবহণের চলার পথটা পরিষ্কার রাখতে হবে। বড় একটি পরিকল্পনা ও জায়গা তাকে দিতে হবে। আমরা যদি ছোট ছোট গাড়িগুলোকে ঢালাওভাবে জায়গা করে দিতে থাকি, তাহলে শহর থেকে কোনোদিন যানজট যাবে না।’
ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশ হাইকোর্ট থেকে আসার বিষয়টির অবশ্য সমালোচনা করলেন এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার না পেরে আদালত থেকে আদেশ নিয়ে এসেছে। আগের সরকারও সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অবাধে চলাচলের অনুমতি দিয়ে গেছে। তখনো যদি প্রধান সড়ক বা মহাসড়ক বাদ দিয়ে কেবল শাখা সড়কগুলোতে অটোরিকশা চলাচলের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে আজ এত ঝামেলা পোহাতে হতো না।
তবে শেষ পর্যন্ত মূল সড়কে অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অনড় অবস্থানেই থাকতে চান শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘আজ যা ঘটছে (রিকশাচালকদের বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভ), তার পেছনে অটোরিকশার সরবহারকারীরা রয়েছে। তারাই এই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ আয়োজন করেছে। সামনে সাইনবোর্ড হিসেবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু পরিচ্ছন্ন শহর চাইলে, যানজট কমাতে চাইলে সরকারকে অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।’
সারাবাংলা/জেআর/টিআর
অটোরিকশা তিন চাকার যানবাহন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ব্যাটারিচালিত রিকশা রিকশা রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত