কেন নেতানিয়াহুর নামে পরোয়ানা, তাকে গ্রেফতারই বা করবে কে?
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৪৮
ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ারা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। একই সঙ্গে ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালেন্তে ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সশস্ত্র মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের নেতা মোহাম্মদ দিয়েফের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই পরোয়ানা।
এরই মধ্যে এই গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর আলোচনা ফেলেছে সারা বিশ্বে। নেতানিয়াহু নিজে আইসিসিকে ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইসরায়েলের মিত্রদেশ বৈশ্বিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রও সেই পরোয়ানাকে ‘ভয়ংকর’ বলে মন্তব্য করেছে। তবে ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই আইসিসির সিদ্ধান্তের প্রতি শদ্ধাশীল বলে জানিয়েছে।
কিন্তু কেন আইসিসি এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে? এই গ্রেফতারি পরোয়নার প্রভাব কী? নেতানিয়াহুকে কি গ্রেফতার করা যাবে এই পরোয়ানার মাধ্যমে? আইসিসির এই গ্রেফতারি পরোয়ানা মানতে কি বাধ্য কোনো দেশ? এসব প্রশ্নই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে অনলাইন-অফলাইনে। দ্য গার্ডিয়ানের লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স করেসপন্ডেন্ট হারুন সিদ্দিকও এত প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এসব প্রশ্নের উত্তর।
কেন গ্রেফতারি পরোয়ানা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে?
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের ইসরায়েলে হামলার পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় যে পালটা হামলা-আক্রমণ চালাতে শুরু করেছে, নেতানিয়াহু ও তার ওই সময়কার প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালেন্তে এবং হামাস নেতা মোহাম্মদ দিয়েফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আইসিসির তিন বিচারকের প্যানেল বলছে, নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধ করেছেন, এটা বিশ্বাস করার মতো পর্যাপ্ত যৌক্তিকতা পেয়েছেন তারা। যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য নেতানিয়াহু বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষুধাকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গণহত্যা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধও করেছেন। শুধু তাই না, ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার নির্দেশ দেওয়ার মতো যুদ্ধাপরাধও নেতানিয়াহু করেছেন বলে বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
আরও পড়ুন- আইসিসিকে ইহুদিবিদ্বেষী বললেন নেতানিয়াহু
মোহাম্মদ দিয়েফের বিরুদ্ধেও হত্যা, নির্মূল করা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করেছে বিচারক প্যানেল। হত্যা, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, জিম্মি করে রাখা, ব্যক্তিমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন নির্যাতনের মতো যুদ্ধাপরাধ তিনি করেছেন বলে বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলে অভিহিত করেছেন বিচাকরা।
আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর করিম খান গত মে মাসে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের জন্য জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলেন। তাতে হামাসের আরও দুই নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়া ও ইসমাইল হানিয়ার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানার আরজি ছিল। তবে তাদের দুজনেই নিহত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি। ইসরায়েল অবশ্য দাবি করেছে, দিয়েফও নিহত হয়েছেন। আইসিসি জানিয়েছে, তার মৃত্যুর বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করবে কে?
আইসিসির নিজে থেকে নেতানিয়াহু, গ্যালেন্তে বা দিয়েফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার মতো কাঠামো নেই। এর জন্য তাকে নির্ভর করতে হবে ‘রোম সংবিধি’তে সই করা ১২৪টি দেশের ওপর, যাদের সম্মতির ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদলত গঠিত। ইউরোপ-এশিয়া-আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ এই তালিকায় থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের মতো দেশগুলো এই তালিকায় নেই। রোম সংবিধিতে সই করেনি ইসরায়েলও। তবে ফিলিস্তিন রোম সংবিধিতে সই করেছে, যাকে আইসিটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে।
বিধি বলছে, আইসিসি যদি কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে, ওই ব্যক্তি এসব সদস্য দেশের কোনো একটিতে অবস্থান করলে ওই দেশ সেই পরোয়ানা তামিল করতে বাধ্য। ফলে রোম সংবিধিতে সই করা দেশগুলোতে ভ্রমণের বিষয়ে নেতানিয়াহু, গ্যালেন্তে বা দেইফকে সতর্ক থাকতে হবে।
এর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ ও সেখান থেকে ইউক্রেনীয় শিশুদের অপহরণের অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল আইসিসি। পরোয়ানা জারির পর পুতিনের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সূচি নির্ধারিত ছিল। তবে ওই পরোয়ানার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা যাননি। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকাও রোম সংবিধিতে সই করা দেশ, যারা পুতিনকে গ্রেফতারের পরোয়ানা তামিল করতে বাধ্য।
আরও পড়ুন- নেতানিয়াহু-গ্যালান্তে ও হামাসের দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
কোন কোন দেশে গ্রেফতার হতে পারেন নেতানিয়াহু?
আগেই বলা হয়েছে, ইসরায়েল বা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্র নেই আইসিসির বিধান অনুসরণ করতে বাধ্য দেশগুলোর তালিকায়। ফিলিস্তিনে ইসারয়েলের আগ্রাসনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য যেসব দেশের কথা ভাবা হচ্ছে সেই কাতার বা মিশরও সেই তালিকায় নেই। অবশ্য নেতানিয়াহু বা গ্যালেন্তের কেউই এসব যুদ্ধবিরতির আলোচনায় সশরীরে অংশ নিচ্ছেন না। ফলে এসব দেশের আইসিসিতে থাকা বা না থাকায় কিছু যায় আসেনা।
আইসিসির সদস্য দেশগুলোর তালিকায় ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে জার্মানি। সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি দেশগুলোও আইসিসির সদস্য। এশিয়া-প্যাসিফিকের দেশগুলোর মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, জর্ডান, মালদ্বীপ আইসিসির সদস্য। কিউবা ছাড়া ল্যাটিন আমেরিকার সব দেশগুলো রয়েছে এই তালিকায়। রয়েছে আফ্রিকার ৩৩টি দেশ।
ইসরায়েল সদস্যদেশ না হলেও আইসিসি কীভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল?
আইসিসির বিধান বলছে, এর কোনো সদস্যদেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপরাধের অভিযোগ পেলে সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারকাজ পরিচালনা করতে সক্ষম। পাশাপাশি এর কোনো সদস্যদেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সেই অপরাধের বিচারও করতে সক্ষম আইসিসি, সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত দেশ এর সদস্য কি না, সেটি বিবেচ্য নয়।
ফিলিস্তিন ২০১৫ সালে রোম সংবিধিতে সই করে। এরপর ২০২১ সালে আইসিসি একে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সদস্যদেশ করে নেয়। ফলে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তা আমলে নিয়ে আইসিসি বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারে। ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলে থাকা পূর্ব জেরুজালেমসহ গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংকে কোনো অপরাধ ঘটলেও তাই তা আইসিসির অধীনে বিচার্য। নেতানিয়াহু, গ্যালেন্তে ও দিয়েফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদনকারী কে এই করিম খান?
এ বছরের মে মাসে নেতানিয়াহু-গ্যালেন্তে ও হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলেন করিম খান। ব্রিটিশ এই আইনজীবী ২০২১ সালে গোপন ব্যালট পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে আইসিসির চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পান। এর আগে ২০০৭ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত কেনিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো এবং সিয়েরা লিওনের বিশেষ আদালতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট চার্লস টেইলরের মামলা পরিচালা করেছিলেন তিনি।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এমন একটি সময়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, যে সময়টি করিম খানের জন্য কিছুটা স্পর্শকাতর। কারণ তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে একটি তদন্ত চলছে। অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন স্পর্শ, দীর্ঘ সময় ধরে যৌন হয়রানিমূলক কথাবার্তা বলাসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ত্রিশের কোটায় থাকা যৌন হয়রানির শিকার ওই নারী গণমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে করিম খান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত কার্যক্রমে পুরোপুরি সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
সারাবাংলা/টিআর
আইসিসি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত(আইসিসি) ইয়োভ গ্যালেন্তে ইসরায়েল করিম খান গ্রেফতারি পরোয়ানা ফিলিস্তিন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মানবতাবিরোধী অপরাধ মোহাম্মদ দিয়েফ যুদ্ধাপরাধ রোম সংবিধি হামাস