‘নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে, এবার রোডম্যাপ দিন’
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ২০:১৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। এখন জনগণের হাতে দ্রুততার সাথে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করুন। অনতিবিলম্বে নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। দ্রুততার সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে গণঅভ্যুত্থানের চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
শনিবার (২৩ নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন চত্বরে সিপিবি জেলা কমিটি আয়োজিত এক গণসমাবেশে প্রধান বক্তার বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘মাত্র সাড়ে তিনমাস আগে যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের কথা আমরা সবাই জানি। ২০০৮-০৯ সালে তারা ভোট করে ক্ষমতায় এসেছিল। মানুষ আশা করেছিল, তারা হয়তো অতীতের ভুলভ্রান্তি কাটিয়ে দেশের মানুষকে শান্তি দেবে। কিন্তু তারা একযুগেরও বেশিসময় ধরে দেশে লুটপাটের রাজত্ব, ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছে। বাংলাদেশের মানুষের একটি শেষ অস্ত্র ছিল ভোট, তারা সেটাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা একটা নতুন তত্ত্ব দেশের সামনে হাজির করল- উন্নয়ন করতে হবে, উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রহীনতা কিংবা আরও যা যা করতে হবে হোক, তা-ই করে ক্ষমতায় থাকতে হবে। সেভাবেই তারা একযুগেরও বেশি ক্ষমতায় টিকে থাকলো।’
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসক শেষপর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না, তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। আমাদের নরম কথায় কান দেয়নি। আমরা কথা বলতে গেলে আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আশপাশে একদল চামচা গড়ে তোলা হয়েছিল। তারা কথায় কথায় বলতো, উনি যা করছেন সব ঠিক করছেন। আমরা বলেছিলাম- বাংলাদেশ কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের দেশ, শেষপর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে তাদের পতন হয়েছে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো স্বৈরশাসক।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এ ইতিহাস মনে রাখা দরকার, বারবার মনে করা দরকার। স্বৈরশাসকের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার ইতিহাস মনে করিয়ে দিলাম এ কারণে, যারা ক্ষমতায় আছেন বা আগামীতে আসবেন- এ ইতিহাস মনে না রাখলে তাদেরও কিন্তু একই পরিণতি হবে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাড়ে তিনমাস শাসনকাল প্রসঙ্গে প্রিন্স বলেন, ‘সাড়ে তিনমাস হয়ে গেল, ব্যবস্থার তেমন একটা বদল হলো না। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে, সিন্ডিকেট বহাল আছে, বাজারের অবস্থা ভয়াবহ। গ্রামে গিয়ে মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, বাজারের কি অবস্থা? লোকজন বলল- ভাই, এটার অবস্থা খুব খারাপ, তবে আরও খারাপ অবস্থা হচ্ছে গরুছাগল চুরি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই।’
তিনি বলেন, ‘সরকারকে বলতে চাই, আপনারা সাড়ে তিনমাসেও জনজীবনে শান্তি আনতে পারলেন না, জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারলেন না। তার অর্থ হচ্ছে, স্বৈরাচারি ব্যবস্থা আপনারা ভাঙতে পারেননি। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ ছিল এসব ব্যবস্থা বদলের দিকে হাত দেওয়া। কিন্তু আমরা দেখলাম, সাড়ে তিনমাসেও সরকার সেদিকে হাত দিল না। হাত দেওয়ার আলামতও দেখলাম না।’
সরকারের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘কাজ ঠিকঠাক করুন, আমাদের সহযোগিতা পাবেন, জনগণের সহযোগিতা পাবেন। কিন্তু কাজ না করে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করবেন না, অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, শহিদের রক্তকে কলুষিত করবেন না। আজ কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কেন বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ? আওয়ামী লীগ তার স্বৈরাচারি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছে, আমরা সেটা মানি না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, আমরা সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেব না। বাহাত্তরের সংবিধান আমাদের আরেকটা অর্জন, সেটাকে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেব না।’
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আপনি অন্তর্বর্তী সরকার, আপনার কাছে আমরা সব প্রত্যাশা করি না। আপনি বিপ্লবী সরকারও না, আবার রেগুলার সরকারও না। রেগুলার মানে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, এমন সরকার আপনারা না। সুতরাং আপনাকে অল্প কিছু কাজ করে যেতে হবে।’
প্রিন্স বলেন, ‘আমাদের দেশবাসী ভোটবঞ্চিত। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে, এটা আপনার অন্যতম ম্যান্ডেট। তার মানে হঠাৎ করে একটা নির্বাচন নয়, নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে তারপর নির্বাচন দেন। সরকারকে বলব- আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু আলোচনাই শুরু হলা না, নতুন নতুন তত্ত্ব আনা হচ্ছে- সংস্কার, সংস্কার, সংস্কার। আমরা বলেছিলাম, সংস্কারের আগে আলোচনা করুন। তারা বলছেন- আলোচনা নয়, কর্মশালা করবেন। আমরা বলি- কর্মশালা দিয়ে আলোচনা হবে না, এনজিওর কর্মশালায় কী হয় সেটা আমরা জানি। আমরা কর্মশালা চাই না, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে। আলাপ-আলোচনা করতে হবে, আলোচনায় বসুন।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থার পুরো সংস্কার করুন। নির্বাচনে দাঁড়ানো এবং ভোট দেওয়ার অধিকার লাগবে। টাকা, পেশিশক্তি, প্রশাসনের কারসাজিমুক্ত ভোট করার সুযোগ তৈরি করুন। তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করুন, দলীয়করণমুক্ত করুন। এটাই সংস্কারের মূল কাজ। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য তিনমাস লাগবে কেন? ১৫ দিনেই তো সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। এখন জনগণের হাতে দ্রুততার সাথে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করুন। অনতিবিলম্বে নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনুন, জিনিসপত্রের দাম সহনীয় করুন। সিন্ডিকেটে হাত দিন, সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিন।’
প্রিন্স বলেন, ‘আর গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া শক্তি সম্পর্কে সজাগ থাকুন। পতিত স্বৈরাচার সম্পর্কে সজাগ থাকুন। দেশের মধ্যে আবার দুর্বৃত্তগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের কিন্তু কোনো দল নেই। এক দখলদারের পরিবর্তে আরেক দখলদার এসে গেছে। সচিবালয়ে আগে ছিল এক গ্রুপের তাফালিং, এখন আরেকগ্রুপ তাফালিং শুরু করেছে। সুতরাং এক দখলদারের পরিবর্তে আরেক দখলদার নয়, এক চাঁদাবাজের পরিবর্তে আরেক চাঁদাবাজ নয়।’
চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহার সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন, দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃণাল চৌধুরী ও জেলা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
সমাবেশ শেষে একটি মিছিল নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন, নিউমার্কেট, সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লা হয়ে চেরাগি পাহাড় মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
সারাবাংলা/আরডি/এইচআই
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চট্টগ্রাম নির্বাচনি রোডম্যাপ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রুহিন হোসেন প্রিন্স