কপ২৯ সম্মেলন
অবশেষে ব্যর্থতার সুর পালটে সফলতার গল্প
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৩৭
বাকু (আজারবাইজান) থেকে ফিরে: জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন (কপ২৯) সম্মেলনের এবারের আসর বসেছিল পূর্ব ইউরোপের দেশ আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। সম্মেলনের শুরু থেকেই একটা নেগেটিভ ক্যাম্পেইন কাজ করেছিল যে, কপ২৯ সফলতা পাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলতার গল্প দিয়েই শেষ হলো জলবায়ু সম্মেলন।
‘এবারের বাকু সম্মেলন থেকে সবাইকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে’- এমন আশঙ্কার মধ্যেই আজারবাইজান ও কপ প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ সম্মেলনের সময় একদিন বাড়িয়ে দেন। ওই দিন শুরু হয়ে দেন দরবার। এই আলোচনায় যোগ দেন উন্নত দেশগুলোর নেতারাও। অবশেষে ২৪ নভেম্বর স্থানীয় সময় ভোর ৩ টা ৩৯ মিনিটে সফলতা ছিনিয়ে আনার খবর জানা যায়। কপ মহাসচিব চুক্তির কপি দেখিয়ে ভাষণ দেন, উন্নয়নশীল ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য প্রতিবছর ৩০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ধনী দেশগুলো।
প্রেসিডেন্ট ইলহাম কপ২৯ আয়োজন করে যেমন দেশকে লাভ করেছেন, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ব্র্যান্ডিং করেছেন, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্যও সফলতা ছিনিয়ে এনেছেন। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩০০মিলিয়ন ডলার আদায় করেছেন। আগামী ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এই অর্থ ধনী দেশগুলো জলবায়ু ফান্ডে জমা দেবে। এর পর সেই অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ভাগ করে দেওয়া হবে।
যে কারণে বাকু সম্মেলনের সফলতা নিয়ে আশঙ্কার ছিল
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাকু সম্মেলন ব্যর্থ হলে এর পেছনে দায়ী থাকতো আন্তর্জাতিক রাজনীতি। কারণ, বিশ্ব রাজনীতির কব্জায় বন্দি হয়ে পড়েছিল কপ। যার বড় উদাহরণ আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ফ্রান্সসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ ‘পাপুয়া নিউগিনি’ এবারের জলবায়ু সম্মেলন শুরুতেই বয়কট করেছে।
উল্লেখ্য, কপ২৯-এ মূল আলোচনার বিষয় ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প। এক পর্যায়ে ধারণা করা হয়, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ওপর-ই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের জলবায়ু আলোচনা কোন দিকে যাবে। কারণ, প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী হওয়ার পরও জীবাশ্ম জ্বালানির প্রসারকে তিনি উৎসাহিত করেছেন। অন্যদিকে, পরের বার জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রকে ফের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরিয়ে আনেন। তেল-গ্যাস উৎপাদন কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিপুল বিনিয়োগ করেন।
অপর দিকে, বাকু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্মেলনে অংশ নেননি। এ কারণে কপের সফলতা নিয়ে সংশয় ছিল।
কপের মতো এতবড় একটি আয়োজন কোনোভাবেই আজারবাইজানকে দিতে চায়নি জাতিসংঘ। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর সমর্থনও ছিল না। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো চায়নি। ফ্রান্সের কড়া প্রতিবাদ ছিল বাকুতে সম্মেলনের ব্যাপারে। তবে রাশিয়াকে ম্যানেজ করে কপ আয়োজন করতে অনুমতি পায় বাকু। এর পরই মূলত বাকু কপ২৯ আয়োজনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। কপ প্রেসিডেন্ট পুরো দেশের মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসে। কপ২৯ সফলভাবে আয়োজনে পুরো দেশের মানুষ এক হয়ে যায়। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে শেষ হয় কপ২৯ সম্মেলন।
রাশিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে যেহেতু বাকু সম্মেলন আয়োজন হয়েছে তাই পশ্চিমা দেশগুলো চাইছিল যাতে বাকু সম্মেলন ব্যর্থ হয়। এজন্য নানা কুটনৈতিক তৎপরতাও দেখা গেছে বাকু সম্মেলনে। বাকু সম্মেলন ব্যর্থ করার টার্গের নিয়ে নেমেছিল বিশ্বের বড় বড় করপোরেট শক্তিও। কিন্তু সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে অবশেষে সফলতার গল্প শোনাল কপ২৯।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিসিসিএডি’র প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সুমাইয়া বিনতে সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোর সহনশীলতার অভাব ও জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থ না দেওয়ার মানসিকতার কারণেই কপ২৯ ব্যর্থ হতে পারত। শুরুতে তারা কথা দিয়েছিল যে, উন্নয়নশীল ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে থাকবে তারা। মাঝখানে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। তবে শেষ মুহূর্তে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম সত্যি চমক দেখিয়েছে। ১০০ মিলিয়ন ডলারের পরিবর্তে এখন ৩০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা নিয়ে এসেছে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য।’
সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী মো. শামছুদ্দোহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘জলবায়ুর সংকট মোকাবিলা নিয়ে সমঝোতার বিষয়টি উন্নত দেশগুলো প্রথম দিক থেকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। কার্বন নির্গমন হ্রাসে উন্নত দেশ কোনো লক্ষ্যমাত্রা মেনে নিতে চায় না। এমনকি ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হয় না। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্রহণে জলবায়ু সম্মেলনই গ্রহণযোগ্য প্লাটফর্ম, সেহেতু এসব সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর ওপর উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।’
তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠানের কাঠামো এবং পদ্ধতিগত সংস্কার দরকার বলে মনে করেন জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করা এই গবেষক।
উল্লেখ্য, বাকুর কপ২৯ সম্মেলনে কেউ ভাবতেই পারেনি যে, সময় বাড়িয়ে ভোর রাতে সফলতার গল্প ছিনিয়ে আনবেন কপ প্রেসিডেন্ট ইলহাম। বিষয়টি আশ্চার্যজনক হলেও এটিই সত্যি। বাকু সফলতা পেয়েছে, সঙ্গে সফল ইলহামও।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম