Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহিউদ্দিন ফারুকীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের লোমহর্ষক বর্ণনা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:১৫

ফারুকীর হাতে গুম পরিষদের সংবাদ সম্মেলন। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: কৃষিবিদ ফসিউল আলম। ফেসবুকে গ্রুপ খুলে লেখালেখি করতেন। সরকারের সমালোচনা করতেন। এ জন্য তিনি ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট গুমের শিকার হন। তার দাবি, র‌্যাব-১০ এর তৎকালীন অফিসার পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী তাকে ‍তুলে নিয়ে যান। এর পর হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে চালায় অমানুষিক নির্যাতন।

মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বেলা ১২টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তৃতীয় তলার হলরুমে ফারুকীর হাতে গুম পরিষদ নামে একটি সংগঠনের আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে ফসিউল আলম এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলেন।

বিজ্ঞাপন

ফসিউল আলম বলেন, ‘নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, বর্ণনা করতে গিয়ে এখনো ট্রমাটাইজ হয়ে যাই। প্রথমদিনই আমাকে শুইয়ে বাঁশডলা দেয়, যা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। এর পর আমি জ্ঞান হারিযে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর আবার শুরু হয় নির্যাতন। বলে কেন সরকারের সমালোচনা করিস তুই। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা হাতকড়া পরা আর চোখ বাঁধা থাকত। কোনো কোনো সময় হাতকড়া পরিয়ে হাত পেছনে রাখা হতো।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘পেরেক সাটানো কাঠে পায়ের তালু রাখত। ওপরে পেটাতো। চর থাপ্পর মারত। হাতের আঙ্গুলে এমনভাবে নির্যাতন করেছে যে, কারাগারে পাঠানোর পর ভাত তুলে খেতে পারতাম না। অন্যরা আমাকে ভাত তুলে খাওয়াতো। পরিবারকে না জানিয়ে মহিউদ্দিন ফারুকীর টর্চার সেলে রেখে দীর্ঘদিন নির্যাতনের পর ক্রসফায়ার দেওয়ার নাম করে বাইরে নিয়ে যায়। মেঘনা ব্রিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ছেড়ে দেয়। এর পর হেঁটে চলে যেতে বলে। যাওয়ার সময় পেছন থেকে দু’জন গিযে আবার হাত জাপটে ধরে। মানুষজন জড়ো করে বলে, এ একজন সন্ত্রাসী, সে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন। তাই তাকে হাতে-নাতে গ্রেফতার করা হলো। এর পর র‌্যাব-১০ এ নিয়ে আসার পর মহিউদ্দিন ফারুকী তার রুমে ডেকে নিয়ে বলেন, এতদিন যা হবার হয়েছে। আজ তুই আসামি। আগের কথা কাউকে বলবি না। আজ তোকে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হবে।’

বিজ্ঞাপন

এভাবে নির্যাতনের কথা বলতে বলতে কৃষিবিদ ফসিউল আলম র‌্যাবের কসাইখ্যাত কর্মকর্তা মহিউদ্দিন ফারুকীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

মহিউদ্দিন ফারুকীর হাতে গুমের শিকার আরেক ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির। তিনি ছাত্রদলের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো রাজনীতি করতেন না। তবে ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করে লেখালেখি করতেন। ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর তিনি গুমের শিকার হন।

হুমায়ুক কবির বলেন, ‘চোখ বাধা অবস্থায় মহিউদ্দিন ফারুকীর কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর আমাকে একটি চেয়ারে বসায়। এর পর চোখ খুলে দেয়। দুই হাতের হ্যান্ডকাপ খুলে দেয়। এর পর ফারুকী বলেন, চা খাবেন। আমি বলি, না চা খাব না। বলেন, না খান। আপনি খেলে সঙ্গে আমরাও খেতে পারি। তখন আমি রাজি হই। এর পর বলেন, রং চা, নাকি দুধ চা? আমি বলি, রং চা। একথা বলার পর অফিসার বলেন, এই তিনি লাল চা খাবেন, দাও। তখন দাঁড়িয়ে থাকা একজন আমার গাল ও গলা বরাবর একটা লাথি মারেন। আমি চেয়ারসহ দূরে পড়ে যাই। এর পর দেখি আমার চোয়ালের একটি দাঁত ভেঙে গেছে। আবার তুলে নিয়ে ডান কাঁধের মধ্যে ভারি কোনো কিছু দিয়ে এমন আঘাত করে যে, আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর পায়ের তালু পেরেক মারা তক্তার ওপর রেখে হাঁটুতে মারতে থাকে। আমি এখনো ঠিক মতো দাঁড়াতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে একটি অন্ধকার ঘরে রেখে নির্যাতন চালাতো। মুখ ও নাক দিয়ে রক্ত আসতে শুরু করে। শরীরের ব্যাথায় নড়াচড়া করতে পারি না। প্রস্রাব করতে চাইলে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। সেখানে জ্বালাপোড়া করায় হাত দিয়ে চোখ খুলি। দেখি রক্ত বের হচ্ছে। এর পর সহ্য না করতে পেরে চিৎকার করি। কেন চোখ খুললাম এজন্য আবার নির্যাতন করে। হাতের আঙুল থেঁতলে দেয়। খাবার খেতে পারতাম না। ওরা খাবার জোর করে খাওয়াতো। খাবারের সঙ্গে ওষুধ দিয়ে দিতো। এর পর নাটক সাজিয়ে আমাকে কারাগারে পাঠায়।’

গুমের শিকার ড. এনামুল হক মনি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তার ওপর চলা অমানুষিক নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর কোরিয়া ফেরত যাওয়ার সময় ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে মহিউদ্দিন গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এর পর আমার স্ত্রীর কাছে অপহরণের কথা বলে দেড় লাখ টাকা নেয়। স্ত্রী অপরপ্রান্ত থেকে কল রেকর্ড করেন। টাকা নেওয়ার পরও যখন আমাকে ছাড়ছিল না তখন তিনি থানা পুলিশের কাছে যান। তখন বিষয়টি সামনে আসে।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘পত্র-পত্রিকায় আমাকে অপহরণের নিউজ প্রকাশিত হলে মহিউদ্দিন ফারুকী নাটক সাজায়। ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়। বলে- তুই নামাজ পড়ে নে, তোকে নিয়ে অভিযানে যাব। এর মধ্যে নানারকম শারীরিক নির্যাতন করেন। আমার কোনো দোষ ছিল না। কারণ, আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। কোনো লেখালেখিও করতাম না। আমার অনেক টাকা আছে, তাই আমাকে অপহরণের নামে গুম করার চেষ্টা করে ফারুকী। আমাকে ২৪ নভেম্বর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সামনে রাত আড়াইটার দিকে নামিয়ে দেয়। বলে চলে যাও। তখন পা বাড়াতেই মহিউদ্দিন ফারুকী ফের আমাকে জাপটে ধরে। তখন ট্রেনের টিকিট (পাবনার ঈশ্বরদী থেকে বিমানবন্দর) পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে লোকজনকে ডেকে বলে, এই সেই সন্ত্রাসী, তাকে আমরা খুঁজছিলাম। টিকিট বের করে দেখিযে বলেন, আজ সে পাবনা থেকে ঢাকায় আসছে। এর পর আবার আমাকে র‌্যাব-২ এর বসিলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নির্যাতন চালানোর পর এক রুমে নিয়ে যায়। সেখানে নেমপ্লেটে দেখতে পাই কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকী। ভেতরে ঢুকে দেখি তিনি চেয়ারে বসে আছেন।’

এনামুল হক মনি, পাবনা সদর থানার রাধানগরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ফজলুল হকের ছেলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মনি সবার ছোট। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার খিয়ংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করেছেন। তিনিও গুমের বর্ণনা দেন। সংবাদ সম্মেলনে গুমের শিকার হওয়াদের মধ্যে বক্তব্য দেন মেহেদী আরমান ইভান, ওয়াসিম ইফতেখারুল হক ও রেজওয়ানুল হক শোভন।

তাদের সবার দাবি, মহিউদ্দিন ফারুকী বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গুম ও ক্রসফায়ারের নৃশংস পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একজন প্রধান কারিগর। তার নামে এরই মধ্যেই বাংলাদেশ গুম কমিশনে শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন গুমের শিকার ব্যক্তিরা।

উল্লেখ্য, মহিউদ্দিন ফারুকী যখন র‌্যাব-১০ এ ছিলেন তখন তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন। আর তিনি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর বদলি হয়ে র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার হন।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

গুম টপ নিউজ মহিউদ্দিন ফারুকী শিকার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর