Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডেঙ্গু আতঙ্কের মাঝেই শনাক্ত হলো চিকুনগুনিয়া ও জিকা

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৭ নভেম্বর ২০২৪ ১১:০০

ক্রায়োইলেকট্রন মাইক্রোসকোপির মাধ্যমে জিকা ভাইরাস (বাঁয়ে) ও চিকনগুনিয়া ভাইরাসের গঠন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমসনস

ঢাকা: ক্যালেন্ডারের হিসাবে ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হলেও কমছে না সংক্রমণ ও মৃত্যু। নভেম্বর মাসেও এডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে রোগী, মৃত্যুবরণও করছে। প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। এর মধ্যেই দেশে শনাক্ত হয়েছে চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরও সারাবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ধানমন্ডি, বনানী, শ্যামলী এলাকার রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করে চিকুনগুনিয়া ও জিকা সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফরও সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। রোগ দুটি কতটা পরিসরে বিস্তৃত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস— এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রোগ হলেও সবগুলোর জন্যই দায়ী এডিস মশা। চিকুনগুনিয়ার কারণে স্নায়ুবিদ রোগ জটিলতাও কম নয়। আর গর্ভবর্তী নারীরা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্কের অসম্পূর্ণতা ও গঠনগত জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্করা জিবিএস বা গুলেনবারি সিনড্রমের মতো প্রাণঘাতী রোগের শিকার হতে পারেন। তাই কদিন পরপরে নিবিড়ভাবে মশার গতিপ্রকৃতিতে নজরদারি জরুরি। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক মৌসুমে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস সংক্রমণ একসঙ্গে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। আর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বছরের শেষ ভাগেও আসলে স্বস্তি মেলবে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে রাজধানীর বেশ কিছু হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতা কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে গেলে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই তাদের মাঝে চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস সংক্রমণ দেখা যায়। তবে মোট কতজন রোগী এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া বা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন তা আইইডিসিআর এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি।

চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্তের বিষয়ে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়ার রোগী পেয়েছি। তুলনামূলকভাবে কম হলেও জিকা ভাইরাসের রোগীও পাওয়া যাচ্ছে এখন।

জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি উল্লেখ করে ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, একইসঙ্গে যেহেতু ডেঙ্গুতেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ তাই সবার সচেতন হওয়া জরুরি। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একসঙ্গে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অথবা নমুনা সংগ্রহ করে সেটা পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। রোগী শনাক্ত হলে অবস্থা জটিল হওয়ার আগেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা কম হবে।

ডা. মুশতাক আরও বলেন, যদি শনাক্তই না হয় তবে দেখা যায় রোগী তার দৈনন্দিন কাজ করে বেড়ান, আর এরপর হঠাৎ একদিন প্রেশার কমে শকে চলে যান। তখন রোগীকে হাসপাতালে আনতে আনতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে। চিকুনগুনিয়াতে মৃত্যুহার অবশ্য খুব কম। তবে শরীরে প্রচুর ব্যথা হয়। যদি আগে থেকে শনাক্ত করা যায়, তাহলে রোগী মানসিকভাবে প্রস্তুত থেকে ব্যথার চিকিৎসা নিতে পারে।

জিকা হলে প্রাথমিক পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসা নিতে পারলে ক্ষতির মাত্রা কম হবে বলে উল্লেখ করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক। তিনি বলেন, আমাদের এডিস মশা নির্মূলে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে সেটায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। একটা কাজ করলে সেখানে লক্ষ্য হওয়া জরুরি রোগীর সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা কমছে কি না, তা বিবেচনা করা। কোথায় ওষুধ দিলাম, কী কীটনাশক দিলাম বা কতজনকে স্যালাইন দিলাম সেগুলো তো স্বাভাবিক কাজের আলাপ। কিন্তু আমার উন্নয়নটা হবে ডেঙ্গু কমাতে পারলাম কি না, সেই বিবেচনায়।

ডা. মুশতাক বলেন, স্বস্তির বিষয় হলো— একসঙ্গে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা বাড়ার সম্ভাবনা কম। যেহেতু এখন ডেঙ্গু বেশি তাই বিচ্ছিন্নভাবে চিকুনগুনিয়া হতে পারে। জিকা তার চেয়েও বেশি বিচ্ছিন্নভাবে হতে পারে। যখন দেখা যাবে চিকুনগুনিয়া বেড়ে গেছে তখন বাকি দুইটা কম হতে পারে। জিকা কিন্তু এখনো পর্যন্ত গবেষণা করতে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আসলে সার্ভিল্যান্স জরুরি। কিন্তু ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকার কোনো সার্ভিল্যান্স এখ নেই।

এর আগে ২০১৬ সালের ২২ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো ৬৭ বছর বয়স্ক একজন পুরুষ ব্যক্তির দেহে জিকা ভাইরাস পাওয়া যায়। ওই সময় আইইডিসিআরের পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান। তিনি জানান, ২০১৪-১৫ সালে ডেঙ্গুর ওপর একটি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা চলছিল। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতেই নমুনা সংগ্রহ করছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল— এই চারটা হাসপাতালের এক হাজার ৭০টি নমুনা ছিল আমাদের কাছে।

জিকা ভাইরাস কী?

এডিস মশাবাহিত একটি রোগ জিকা ভাইরাস ডিজিজ। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ অতটা মারাত্মক নয়। তবে অন্তঃস্বস্ত্বা নারীরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়। যেখানে সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশ ঠিক হয় না। ফলে সন্তানের মস্তিষ্কও হয় তুলনামূলক ছোট।

কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ে জিকা ভাইরাস?

কোনো সংক্রমিত এডিস মশা সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে তিনি জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়াতে পারে। এমনকী গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর থেকে ভ্রূণেও সংক্রমিত হতে পারে এই ভাইরাস। গর্ভাবস্থায় এই ভাইরাস শরীরে হানা দিলে একাধিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। গর্ভপাতের আশঙ্কা বাড়ে। সময়ের আগেই প্রসব হতে পারে। তাই এই ভাইরাস থেকে গর্ভবতীদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।

চিকুনগুনিয়া কী?

চিকুনগুনিয়াও একটি ভাইরাসজনিত জ্বর, যা আক্রান্ত মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। এ রোগ ডেঙ্গু, জিকার মতোই এডিস প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। রোগটি প্রথম ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে দেখা যায়। পরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন— ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়াতে এর বিস্তার দেখা যায়।

বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে প্রথম এ ভাইরাসের প্রার্দুভাব দেখা যায়। পরে ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এ রোগ দেখা যায়। তবে এর পরে বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি রোগী ছাড়া এ রোগের বড় ধরনের বিস্তার বাংলাদেশে দেখা যায়নি।

বর্ষার পর পর যখন মশার উপদ্রব বেশি হয় তখন এ রোগের বিস্তার বেশি দেখা যায়।

চিকুনগুনিয়ার লক্ষ্মণ

হঠাৎ জ্বর আসা এবং সঙ্গে গিঁটে গিঁটে প্রচণ্ড ব্যথা এই রোগের প্রধান লক্ষ্মণ। এ ছাড়া প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, শরীরে ঠান্ডা অনুভূতি, বমি বমি ভাব অথবা বমি, চামড়ায় লালচে দানা ও মাংসপেশীতে ব্যথাও এই রোগের কারণে হতে পারে।

চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণত রোগটি এমনি এমনিই সেরে যায়। তবে কখনো কখনো গিঁটের ব্যথা কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছরের বেশি সময় থাকতে পারে।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

এডিস মশা চিকনগুনিয়া জিকা জিকা ভাইরাস ডেঙ্গু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর