দেশে শনাক্ত চিকুনগুনিয়া-জিকা: সরকারিতে পরীক্ষার ব্যবস্থাই ‘নেই’
২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:০১
ঢাকা: ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কাটতে না কাটতেই দেশে শনাক্ত হয়েছে চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী। জনস্বাস্থ্যবিদরা এরই মধ্যে মশাবাহিত এই দুই রোগ নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, এই দুটি রোগ দ্রুত শনাক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সরকারিভাবে এই দুটি রোগ শনাক্ত করার ব্যবস্থাই অপ্রতুল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকুনগুনিয়া বা জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করার জন্য পিসিআর পরীক্ষা করতে হয়। সরকারিভাবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষা করানোর সুযোগ নেই। আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ থেকে সাত দিন পর IgM ও IgG অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করেও এগুলোর উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু সেটিও কেবল সরকারিভাবে একটি প্রতিষ্ঠানেই করার সুযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিকা ভাইরাস ও চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করতে আইজিএম (IgM) পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত করা গেলেও চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির সেনসিভিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এ কারণেই চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য তারা পিসিআর মেশিনে নমুনা পরীক্ষা করাকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করেন। কিন্তু আইইডিসিআর ছাড়া অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ সুযোগ নেই। কারণ সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে পিসিআর ল্যাব থাকলেও সেখানে আলাদা কিট নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে সক্ষমতা না থাকলেও ধীরে ধীরে নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছিল। সেগুলোকেও চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস শনাক্তের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজনীয় কিট সরবরাহ করা প্রয়োজন। কারণ বেসরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষাগুলো করতে গেলে খরচ অনেক বেশি পড়বে, যা এর সহজলভ্যতাকে কমিয়ে দেবে।
চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের আক্রান্তদের শনাক্ত করা হয়েছে অবশ্য বেসরকারি হাসপাতালেই। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে কিছু রোগী ভর্তি রয়েছেন। সেখানেই নমুনা পরীক্ষা করানোর পর (চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার তথ্য) জানা গেছে। তবে আমাদের আইইডিসিআরে চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস— দুটিরই নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।’
আরও পড়ুন- ডেঙ্গু আতঙ্কের মাঝেই শনাক্ত হলো চিকুনগুনিয়া ও জিকা
চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডাইরেক্টর (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ ক্ষেত্রে যারা নমুনা পরীক্ষা করাতে চান, তারা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে (নিলমার) যেতে পারবেন। এখনো রোগীর সংখ্যা কম। ফলে এখানে খুব চাপ হবে না। রোগী বাড়তে থাকলে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
চিকুনগুনিয়া বা জিকা ভাইরাস যেন মহামারি আকার ধারণ না করে, সেটি নিশ্চিত করতে নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন।
সারাবাংলাকে ডা. মুশতাক বলেন, ‘চিকুনগুনিয়া হোক বা জিকা ভাইরাস— আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এসব রোগ শনাক্তের জন্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অথবা নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। রোগী শনাক্ত হলে অবস্থা জটিল হওয়ার আগেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা কম হবে।’
ডা. মুশতাক আরও বলেন, প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ যদি শনাক্ত না হয়, সেটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। দেখা যাবে, রোগী তার দৈনন্দিন কাজ করে বেড়াচ্ছেন। এরপর হঠাৎ একদিন রক্তচাপ কমে শকে চলে যাবেন। তখন রোগীকে হাসপাতালে নিতে নিতেই পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে। চিকুনগুনিয়াতে অবশ্য মৃত্যুহার অবশ্য খুব কম। তবে প্রচুর ব্যথা হয় শরীরে। আগে থেকে শনাক্ত করা গেলে রোগী মানসিকভাবে প্রস্তুত থেকে ব্যথার চিকিৎসা নিতে পারে। আর জিকা ভাইরাস সংক্রমিত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসা নিতে পারলে ক্ষতির মাত্রা কম হবে।
ডা. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এখন এডিস মশার প্রকোপ বেশি। তাই শরীর খারাপ লাগলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। চিকিৎসক রোগীর বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনটা নমুনা পরীক্ষাই করানো ভালো। এই নমুনা পরীক্ষাটা সরকারি খরচে করানো উচিত। রোগীদের পকেটের পয়সা দিয়ে করতে গেলে সাধারণ মানুষের অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব নাও হতে পারে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় সারা দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে পিসিআর ল্যাব তৈরি করা হয়। পিসিআর মেশিনে করোনাভাইরাসের জন্য নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসকে জনস্বাস্থ্যের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এসব ল্যাব ব্যবহার করে নমুনা পরীক্ষার তাগিদ দেন ডা. মুশতাক।
তিনি আরও বলেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস পরীক্ষা করানোর যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে করা জরুরি। আমাদের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ এ ক্ষেত্রে খুব একটা বেশি সমস্যা না। অনলাইনেও সেটা দেওয়া যেতে পারে। তবে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে তেমন কিছুই হয় নাই। আর তাই এটা প্রস্তাবনা থাকবে সরকারের কাছে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
আইইডিসিআর. নমুনা পরীক্ষা এডিস মশা চিকনগুনিয়া জিকা ভাইরাস পিসিআর মশাবাহিত রোগ