আইনজীবী আলিফ হত্যা
ভিডিও-ছবি দেখে শনাক্ত করা হচ্ছে জড়িতদের
২৮ নভেম্বর ২০২৪ ২২:১২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার ঘটনায় সিসিটিভি ও মোবাইলের ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ এবং ছবি দেখে জড়িতদের চিহ্নিত করছে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডে গত দুদিনে ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একইভাবে ঘটনার দিন পুলিশের ওপর হামলা-সংঘাতে জড়িতদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি-মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। বিভিন্নভাবে মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করা কিছু ভিডিও এবং ছবিও আমরা পেয়েছি। সেগুলো দেখে কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। রাজিব নামে একজনকে আমরা গ্রেফতার করেছি, যে সরাসরি খুনের ঘটনায় জড়িত। ভিডিও ফুটেজে এর তথ্যপ্রমাণ আমরা পেয়েছি।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম আদালত ভবনের মূল প্রবেশপথের সামনে রঙ্গম কনভেনশন হলের অদূরে সংঘর্ষের সময় মাটিতে পড়ে থাকা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে মারধর করছেন কয়েকজন। এদের মধ্যে লাল জামা ও মাথায় হেলমেট পরিহিত একজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাইফুলের ঘাড়ে ও পিঠে আঘাত করতে দেখা যায়। এরপর আলিফের পড়ে থাকা নিথর দেহেও কয়েকজন ইট, বাঁশ ও লাঠি দিয়ে আঘাত করেন।
পরে আলিফকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ভাইরাল ওই ভিডিও থেকে সাতজনকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা হলেন- বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শুভ কান্তি দাস, সুমন নন্দী, বিকাশ দে, নারায়ণ চক্রবর্তী, মন্টু দে, রাজিব ভট্টাচার্য ও চট্টগ্রাম বাকলিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি জিয়া উদ্দিন ফাহিম।
এদের মধ্যে রাজীব ভট্টাচার্যকে বুধবার (২৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। এছাড়া আলিফ হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর শুভ কান্তি দাশ নামে এক শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব সাময়িকভাবে বাতিল করেছে বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ। বুধবার (২৭ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. এস এম শোয়াইবের সই করা এক নোটিশে বলা হয়, বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সেদিন যা ঘটেছিল
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় দায়ের হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সোমবার (২৫ নভেম্বর) রাতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইসকনের বহিষ্কৃত সংগঠক ও সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। এ সময় আদালতের বাইরে থাকা ইসকনের সহস্রাধিক অনুসারী ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এর পর চিম্ময় কৃষ্ণকে কারাগারে নেওয়ার সময় পুলিশের প্রিজনভ্যান আটকে রেখে বিক্ষোভ করতে থাকেন তারা। প্রায় দুই ঘণ্টা পর বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেঠা ও সাউন্ড গ্রেনেন্ড দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ ও বিজিবি। এর পর আদালত পাড়ায় শুরু হয় সংঘর্ষ। যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে কোতোয়ালি ও লালদিঘী এলাকায়। এ সময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নৃশংসভাবে খুন হন। এর পর সংঘর্ষের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সংঘর্ষ চলাকালে চিম্ময় দাসকে কড়া নিরাপত্তায় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
একই দিন ইসকন নিষিদ্ধ ও আলিফ হত্যার বিচার চেয়ে নগরীর টাইগারপাস, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, আন্দরকিল্লাহসহ বিভিন্ন স্থানে পৃথক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। দোষীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে টাইগারপাসে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বুধবার (২৭ নভেম্বর) বেলা ১২টার নগরীর টাইগারপাস মোড়ে এ বিক্ষোভ শুরু হয়। দেড় ঘণ্টার বিক্ষোভে হাজার হাজারো ছাত্র-জনতা অংশ নেন। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবি জানান।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে পাঠানোকে কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর হামলা, সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। পুলিশ পক্ষ থেকে করা এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার জনকে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৬ জনকে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৬০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আদালত ভবনের মূল প্রবেশপথের বিপরীতে রঙ্গম সিনেমা হলের সামনের ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া, নগরীর কোতোয়ালিরর মোড়ের ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি-মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আদালতে সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ১৪ জনকে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় শনাক্ত করা হয়েছে। বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের সময় আলিফ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে ৩০ জনকে আটক করা হয়। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ৩ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার সকালে অভিযান চালিয়ে নতুন করে মোট নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
নগর পুলিশের উপ কমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলা, সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ৩৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আইনজীবী খুনের ঘটনায় এখনও কোনো মামলা রুজু করা হয়নি। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথকভাবে তিনটি মামলা করা হয়েছে।’
তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আইনজীবী হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের হয়নি বলে এডিসি কাজী মো. তারেক আজিজ জানিয়েছেন।
সারাবাংলা/আইসি/পিটিএম