Friday 29 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৩১

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: দীর্ঘ সময় ধরেই স্যার আমাকে নানাভাবে কুরুচিপূর্ণ আপত্তিকর প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। মেসেঞ্জারে মেসেজ দেওয়ার পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপে নানা ধরনের প্রস্তাব দিচ্ছিলেন। কখনো গভীর রাতে মদ্যপ অবস্থায় ফোন দিতেন। আমি সেই ফোন না ধরলে আবার বিরক্তি প্রকাশ করতেন। সময়-অসময়ে ভিডিও কল দিতেন। পাশাপাশি আমার ছবি নিয়ে কুপ্রস্তাব দেওয়া ও অফিসে নানা ধরণের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তার মাধ্যমে মানসিকভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন।

বিজ্ঞাপন

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সারাবাংলার প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন সেখানেই কর্মরত একজন নারী মেডিকেল কর্মকর্তা। এরই মধ্যে তিনি এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরে। অভিযোগের পরে ডা. ওমর ফয়সলকে বদলি করা হলেও পরে তিনি আবার একই স্থানে পদায়ন পান।

ওই নারী কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ডা. ফয়সলের এমন হয়রানির পর আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা বললে তিনি কিছুটা নিবৃত্ত হন। পরে আবারও হয়রানি করতে শুরু করেন। আমার স্যার হলেও হোয়াটসঅ্যাপে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে নাম ধরে সম্বোধন করতেন। আমার দেহের গঠন নিয়ে অশালীন মন্তব্য করতেন। স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার কোয়ার্টারে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতেন। আমি রাজি না হওয়ার কারণে মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি সামাজিকভাবেও হেয় করছিলেন। ঘনিষ্ঠ যাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি, তারা মেয়ে বলে সবকিছু সহ্য করে যেতে বলতেন। কিন্তু ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। পরে আমি স্বাস্থ্য অধিদফতরে অভিযোগ করেছি। আশা করছি আমি সুবিচার পাব।

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সল অবশ্য এসব অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন। আর স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অভিযোগের প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ১১ নভেম্বর ডা. ওমর ফয়সলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন ভুক্তভোগী ওই মেডিকেল কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ সংযুক্ত করে দেন ভুক্তভোগী।

বিজ্ঞাপন

সংযুক্ত করা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ভুক্তভোগীকে নানা ধরনের মেসেজ পাঠাতে শুরু করেন অভিযুক্ত ইউএইচএফপিও। মেসেজ পাঠানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সময় কল করার বিষয়টিও দেখা যায় সংযুক্তি করা তথ্যে।

ভুক্তভোগী ওই নারী স্বাস্থ্য অধিদফতরে দেওয়া অভিযোগপত্রে লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সল আমাকে উত্ত্যক্ত করেছেন। প্রায়ই মদ্যপ অবস্থায় মধ্যরাতে আমাকে ফোন দিয়েই যেতেন। ফোন না ধরলে হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে মেসেজ দিতেন। দিনের পর দিন মেসেজ ও কলে কুরুচিপূর্ণ আপত্তিকর প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছেন। ভিডিও কল দেওয়ার চেষ্টা, অফিসে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তার মাধ্যমে মানসিকভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন।’

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ফেসবুক থেকে ওই নারী কর্মকর্তার ছবি নিয়ে তা নিজের ফোনে রাখতেন ড. ফয়সল। সেগুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতেন, ‘কুপ্রস্তাব’ দিতেন। আপত্তিকর সম্বোধন করতেন। তার কথায় রাজি হলে ‘তুমি যা চাইবা তাই পাবা’ মেসেজ দিয়ে রাত্রিযাপনের প্রস্তাবও দিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার জন্যও চাপ দিতেন ড. ফয়সল। ‘কুপ্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান করায় কর্মস্থলে ওই নারী কর্মকর্তাকে বাধা দেওয়াসহ দায়িত্ব থেকে অপসারণের মাধ্যমে স্টাফদের সামনে হেয় করেছেন।

ওই নারী কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘এখন কিছু কথিত অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিকদের আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন ড. ফয়সল। তারা আমার ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে জীবন অতীষ্ঠ করে তুলেছেন। এ কারণে আমি আমার কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। দিনের পর দিন দুশ্চিন্তার জন্য কাজে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে নানাভাবে কুপ্রস্তাবসহ অশালীন মন্তব্য, ফোনে কুরুচিপূর্ণ কথা বলা, মদ্যপ অবস্থায় আমাকে ফোন দেওয়া, আমার ছবি ব্যবহার করে অসংলগ্ন-অশালীন মন্তব্য করাসহ নানা ধরনের যৌন হয়রানির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তার সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’

জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্যার (ইউএইচএফপিও) প্রথম দিকে তিনি আমাকে উত্ত্যক্ত করার পর বলেছিলাম, সিনিয়রদের জানাব। এরপর কিছু দিন তিনি চুপ ছিলেন। পরে আবার মেসেজ ও কল দিতে শুরু করেন। দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে।’

ওই নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘ফরিদপুরে আমি চেম্বার করি। কিন্তু এখন আমি ঘর থেকে বের হলেই নানা ধরনের ভয়ে থাকতে হয়। চেম্বারে আসা রোগীদের পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কথা ছড়ানো হয়েছে। বর্তমানে আমি এক ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরে অভিযোগ জানানো প্রসঙ্গে ওই নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাকে অনেকেই অভিযোগ দিতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ এসব ক্ষেত্রে নাকি যথাযথ বিচার পাওয়া যায় না। আবার অনেকেই বলছিলেন, এ যাত্রায় কোনো ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদফতর নিলেও ভবিষ্যতে তিনি আরও বড় পদে গেলে আমাকে আর চাকরি করতে দেবেন না। কিন্তু আমি যদি আমার কর্মস্থলেই এমন পরিস্থিতির মাঝে পড়ি, তাহলে কোথায় যাব? তাই সাহস করে বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমি স্বাস্থ্য অধিদফতরে অভিযোগ করেছি।’

গত ১১ নভেম্বর ভুক্তভোগীর অভিযোগের পর ১৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এ বি এম আবু হানিফের সই করা এক অফিস আদেশে ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সলকে ফরিদপুরের সদরপুর থেকে বাগেরহাটের মোল্লাহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। তবে চার দিন পরই ১৮ নভেম্বর আরেক অফিস আদেশে তাকে ফের ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলায় পুনর্বহাল করা হয়।

বদলির পর ডা. ফয়সল আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন বলে জানান অভিযোগকারী ওই নারী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “আমি বর্তমানে সংযুক্তিতে আরেক হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছি। তাকে বদলি করার বিষয়ে আমি জানতাম না। কিন্তু উনার কারণা, এর পেছনে আমার অভিযোগের প্রভাব ছিল। সে কারণে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে আমাকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। তার বদলির আদেশ বাতিল হলে নানাভাবে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘এত বছর এখানে আছি। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এত সহজ না।’ এরপর থেকে আরও বেশি মানসিক যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছেন। আর সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা তো চলছেই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএইচএফপিও ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানি না। আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। কে অভিযোগ করেছে, আমি তাও জানি না। আমার এখানে অনেকেই মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে আছেন। অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীও আছেন। তাদের মাঝে কেউ অভিযোগ করেছে বলে আমার জানা নেই।’

অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে ভুক্তভোগীর জমা দেওয়া নানা সময়ের মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। মেসেজে উল্লেখ করা কথাগুলো কোনো সহকর্মীকে বলা যায় কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে যেহেতু জানি না তাতে কী আছে, তাই কোনো মন্তব্য করছি না। এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

বদলি ও চার দিনের মাথায় বদলির আদেশ প্রত্যাহার বিষয়ে ড. ফয়সল বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অন্যদের বদলির আদেশের সঙ্গে আমার নামও ছিল। ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমার ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তাই মানবিক বিবেচনায় আমাকে আবার এখানে পুনর্বহাল করা হয়েছে।’

অভিযোগকারী নারী মেডিকেল কর্মকর্তাকে মানসিক বা সামাজিকভাবে কোনো ধরনের হেয় করা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন অভিযুক্ত ডা. ফয়সল।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এ বি এম আবু হানিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগপত্রটি পেয়েছি। সেটি তাৎক্ষণিকভাবে আমলে নিয়ে আমরা নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছি। তদন্তে যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, অবশ্যই নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বদলির আদেশ বাতিল করে পুনরায় আগের কর্মস্থলে ডা. ফয়সলের পুনর্বহালের বিষয়টি জানতে চাইলে স্বাস্থ্যি অধিদফতরের এই পরিচালক বলেন, ‘অনেক বদলিই এখন হচ্ছে। পুনর্বহালের বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করছি। এ বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।’

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

. ডা. মোহাম্মদ ওমর ফয়সল ইউএইচএফপিও ফরিদপুর যৌন হয়রানি সদরপুর উপজেলা সদরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সহকর্মীকে যৌন হয়রানি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর