পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর
ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধের শর্তে ‘জেএসএসের চুক্তি’ বাস্তবায়নে ‘নমনীয়’ ইউপিডিএফ
২ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:২৮
রাঙ্গামাটি: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সই করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। এরপর পেরিয়ে গেছে ২৭ বছর। কিন্তু সেই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ পাহাড়িদের।
পাহাড়ের অধিবাসীরা বলছেন, ২৭ বছরেও সংঘাত, হানাহানি আর রক্তক্ষরণ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে স্থায়ী শান্তিও ফেরেনি পাহাড়ে। সবুজ পাহাড় হঠাৎ হঠাৎই রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রাজনৈতিক ও জাতিভিত্তিক দল। পাহাড়িদের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জেরে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কাও বেড়েছে।
ওই চুক্তি সইয়ের পরের বছরই পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে পাহাড়ের একমাত্র ও প্রথম আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সম্প্রতি তারা চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে দলটির শর্ত— প্রথমেই জনসংহতি সমিতিকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করতে হবে।
চুক্তি নিয়েই ভাঙন, এক জনসংহতি সমিতি ভেঙে ৪ দল
জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সই করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সময়ে জনসংহতি সমিতির একটি পক্ষ এ চুক্তির বিরোধিতা করে।
সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির চুক্তি সইয়ের পর ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর চুক্তিবিরোধী অবস্থান নিয়েই পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউপিডিএফ পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে আসছে।
২০১০ সালে ফের সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিতে ভাঙন দেখা দেয়। এবার আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন সুধাসিন্ধু খীসা, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা ওরফে পেলে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জনসংহতি সমিতির সঙ্গে রাজনৈতিক বৈরিতা থাকলেও চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষেই সবসময় কথা বলেছে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা)।
এদিকে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। মূলত প্রসিত খীসার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সাবেক ইউপিডিএফ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় দলটি।
ইউপিডিএফ চুক্তির বিরোধিতা করে প্রতিষ্ঠা হলেও ইউপিডিএফ ভেঙে গঠিত ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করছে। সবশেষ অবশ্য ইউপিডিএফও চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষেই কথা বলেছে। সব মিলিয়ে এক পার্বত্য চুক্তি নিয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ভেঙে চার দল হয়েও শেষাবধি সব দলই এখন চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে!
বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি
২০১৭ সালের শেষ দিকে পাহাড়ে সবশেষ রাজনৈতিক দল হিসেবে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আত্মপ্রকাশের পর পাহাড়ে খুনোখুনি বেড়ে যায়। ওই সময়ে খুন হন ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) শীর্ষস্থানীয় নেতারাও।
২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরের নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক মিঠুন চাকমাকে। একই বছরের ৩ মে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের সামনেই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পরদিন শক্তিমানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া (সৎকার) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে খাগড়াছড়ি থেকে নানিয়ারচরে যাওয়ার পথে মাইক্রোবাসে ব্রাশফায়ারে ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। তিন মাস পর ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার স্বনির্ভর বাজারে ইউপিডিএফের রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে গুলি করে সাতজনকে হত্যা করা হয়।
এসব হত্যাকাণ্ড পাহাড়ের আঞ্চলিক তিন রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) মধ্যেই দোষারোপের বৃত্তে বন্দি ছিল।
সবশেষ পাহাড়ে বড় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের অনিল পাড়ায়। এক সঙ্গে ইউপিডিএফের চার নেতা খুন করা হয় সেদিন। এরপর থেকে এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়িতে ১৮ জন নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। ইউপিডিএফের দাবি, হত্যার শিকার সবাই তাদের দলীয় নেতাকর্মী।
এদিকে ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠার পর পাহাড়ের সবচেয়ে পুরনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতির সঙ্গে প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের রাজনৈতিক বৈরিতা কমে আসে। দুদলের মধ্যে সংঘাত বন্ধের পাশাপাশি বৃহত্তর ঐক্যে তারা অলিখিত সমঝোতাও করে।
২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভাঙার পর দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যার ঘটনায় অনেকটা বেকায়দায় পড়ে ইউপিডিএফ। তখন ইউপিডিএফ ও জেএসএস নিজেদের মধ্যকার সংঘাত বন্ধ রাখে। এই সমঝোতার আঁচ পড়েছে গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও। রাঙ্গামাটি আসনে জেএসএসের সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদারের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারে অংশ নেয় ইউপিডিএফ। তবে দ্বাদশের ভোট ইউপিডিএফ শুরু থেকেই বর্জন করে। জনসংহতি সমিতির প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিলেও নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলে পরে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
এর মধ্যে ২০২২ সালের ৯ জুন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ২ নম্বর চেঙ্গী ইউনিয়নের বড়কলক এলাকায় এক অনুষ্ঠানে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. এমদাদুল ইসলামের কাছে একটি দাবিনামা পেশ করেন। চুক্তি আকারে পেশ করা ইউপিডিএফের ৬৬ পৃষ্ঠার দাবিমামায় ৮৭টি দাবি উল্লেখ করা হয়। এ প্রস্তাবের পরপরই পাহাড়ে ইউপিডিএফ-জেএসএসের ফের বৈরিতা দেখা দেয়।
পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একচেটিয়াভাবে ইউপিডিএফের নেতাকর্মী খুনের ঘটনায় দলটির হাঁসফাঁস অবস্থা। রাজনীতির মাঠে জনসমর্থন ধরে রাখতে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি করলেও যে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা, সেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে জোরালোভাবে ধরে থাকতে পারেনি সংগঠনটি। রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে শেষ পর্যন্ত চুক্তির বাস্তবায়নের পক্ষেই কৌশলী অবস্থান নিয়েছে দলটি।
পাহাড়ি-বাঙালি সম্পর্কে বৈরিতা
২০১৭ সালে ২ জুন রাঙ্গামাটির লংগদুতে এক বাঙালি মোটরসাইকেলের চালককে হত্যাকে কেন্দ্র করে পাহাড়িদের ২১২টি ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বাঙালিরা। পরে আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনবার্সনের লক্ষে ২১২টি সেমিপাকা ঘর দেয় সরকার। কিন্তু স্থানীয় বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যেকার মানসিক দূরত্ব ঘোচেনি।
সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটিতে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি সম্পর্কে বৈরিতা আরও তীব্র হয়েছে। এ ঘটনারও সূত্রপাত খাগড়াছড়িতে চোর সন্দেহে এক বাঙালি তরুণকে ‘পিটিয়ে হত্যা’র অভিযোগকে কেন্দ্র করে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়া পাড়ায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে ওই এক বাঙালি তরুণকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়। এরপর জেলা শহর ও দীঘিনালায় সংঘর্ষ হয়। সহিংসতার মধ্যে পরদিন তিনজন নিহতের খবর আসে।
এর জের ধরেই রাঙ্গামাটি জেলা শহরে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে ২০ সেপ্টেম্বর। শহরের বনরূপা থেকে বিজন সরণি পর্যন্ত দোকানপাট, ঘরবাড়ি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। শহরের কালিন্দীপুর এলাকার মুখে এক পাহাড়ি শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত হন চার পাহাড়ি। তখন খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল।
সহিংসতার ঘটনার তদন্তের মধ্যেই ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক বাঙালি শিক্ষককে পাহাড়ি শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করেন পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনার দুই মাসের বেশি সময় কেটে গেল। তদন্ত কমিটি হলো। তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করল। কিন্তু এ ঘটনার আইনি কার্যক্রমের কোনো অগ্রগতির খবর আমরা পাইনি।’
কী বলছে জনসংহতি সমিতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর পূর্তির ক্রোড়পত্রে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ সরকারের সঙ্গে ছয়বার, পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সঙ্গে ১৩ বার ও সর্বশেষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সাতবার, অর্থাৎ পরপর তিনটি সরকারের সঙ্গে মোট ২৬ বার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ধারাবহিকতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়।
ক্রোড়পত্রে দলটি বলছে, সংবিধানের অধীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সব নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের নিজ নিজ অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে এই ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়েছিল।
এতে আরও বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সইয়ের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার ও দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার গঠনের পর প্রায় চার মাস অতিক্রান্ত হলেও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সইয়ের ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারার বাস্তবায়নই হয়নি।
ক্রোড়পত্রে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, ২৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জিত হয়নি। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্বত্যবাসীর অধিকার সনদ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্জিত হয়েছে। এই চুক্তিকে বাস্তবায়িত না করার হীন উদ্দেশ্যে যেকোনো জুম্ম স্বার্থবিরোধী অপতৎপরতা ও প্রচারণা, সর্বোপরি এই চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের যেকোনো চক্রান্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না।
চার দলই চুক্তির পক্ষে, নতুন মেরুকরণ হচ্ছে?
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র অংগ্য মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। আমাদের পার্টি শুরু থেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার যেমন আন্তরিকতা দেখায়নি, তেমনি জনসংহতি সমিতিও (সন্তু লারমা) তেমন জোরালো কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি।’
‘কিন্তু পাহাড়ের বর্তমান পরিস্থিতি ও বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে আমরা পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন চাইছি। জনসংহতি সমিতি যদি জোরালোভাবে আন্দোলন করে, আমরা তাদের সঙ্গে আছি। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই জনসংহতি সমিতিকে আগে পাহাড়ের চলমান ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করতে হবে,’— বলেন অংগ্য মারমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান জুপিটার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘২৭ বছরেও চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি। পাহাড়ে এখনো অশান্ত। বিগত সরকার ক্ষমতার মসনদে বসে ক্ষমতার স্বাদ নিতে প্রতিযোগিতা করেছে মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের রক্ষাকবচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৮টি ধারা আংশিক, ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। আমরা বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের কাছে চুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলোর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনকেও আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। এ কমিশনের কাছে আমাদের দাবি, সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলে যে সব আদিবাসী জাতি রয়েছে, তাদের প্রত্যক জাতির নাম যেন সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমরা আশা করছি, বর্তমান অন্তবর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য বিগত সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন না।’
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক) কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি সরকারের সঙ্গে হয়েছে। আমরা মনে করি, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু দেশকে নতুনভাবে সাজাচ্ছে, সংস্কার করছে, তারা অবশ্যই চুক্তি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।’
সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি ও ভূমি কমিশন পুনর্গঠনের কথা শুনতে পাচ্ছি। এগুলো ইতিবাচক দিক। আমরা মনে করি, এই সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবেন।’
ইউপিডিএফের ‘চুক্তি সমর্থন’ প্রসঙ্গে পিসিজেএসএসের এই নেতা বলেন, ‘তারা (ইউপিডিএফ) চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। এ ছাড়া যারা চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখছে তাদের সঙ্গেই ইউপিডিএফের সখ্য। এখন তারা যদি চুক্তিকে সমর্থন করে, আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে থাকে, তাহলে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের কথা আসে না। তারা আসলে কিভাবে কী ভাবছে, সেটা তারাই ভালো জানবে।’
সারাবাংলা/টিআর
ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জনসংহতি সমিতি জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পিসিজেএসএস প্রসিত খীসা বান্দরবান রাঙ্গামাটি শান্তি চুক্তি সন্তু লারমা