পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৭ বছরেও শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে
২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:০৮ | আপডেট: ২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:১৩
বান্দরবান: পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির দীর্ঘ ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসেনি। এখনো অস্ত্রের ঝনঝনানি, চাঁদাবাজি, খুন, গুম, হত্যা ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত পাহাড়কে তটস্থ করে রাখছে। চুক্তির পর থেকে গড়ে উঠেছে আরও ছয় ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন। তাদের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়অসে কয়েক শ হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদাবাজির ঘটনা অগণিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর স্বাধিকার আদায়ে স্বাধীনতার পরপরই গেরিলা সশস্ত্র সংগঠন (শান্তিবাহিনী) গড়ে তুলেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। পার্বত্য চট্টগ্রমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। পার্বত্য অঞ্চলের স্বাধিকার প্রশ্নে দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক ধরে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পিসিজেএসএসের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সই করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর তৎপরতার অবসান ঘটে।
২৭ বছর আগে সই হওয়া ওই শান্তি চুক্তিতে ধারা ছিল ৭২টি। সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যাশা ছিল, এসব ধারা বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার অবসান ঘটবে। শান্তি ফিরবে পাহাড়ে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, কাগজে-কলমে শান্তিবাহিনী বিলুপ্ত করলেও চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে ২৫টি ধারা, আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে ১৮টি ধারা। বাকি ২৯টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বঞ্চনারও অবসান ঘটেনি।
এদিকে পার্বত্য চুক্তির আগে পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন বলতে কেবল ছিল শান্তিবাহিনী। চুক্তির পর গত ২৭ বছরের গড়ে উঠেছে আরও ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে পিসিজেএসএসের সশস্ত্র গ্রুপ, জেএসএস সংস্কার ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, মগ লিবারেশন আর্মি বা মগ পার্টির সশস্ত্র গ্রুপ এবং সর্বশেষ কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
পাহাড়ের অধিবাসীরা বলছেন, এসব সশস্ত্র গ্রুপের কারণে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুমসহ অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান বেড়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যেই ঘটেছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। ২৭ বছরে এসব সশস্ত্র গ্রুপে তৎপরতায় হত্যাকাণ্ডই ঘটেছে কয়েক শ।
বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত ও সংগঠনগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৮ সাল থেকে এ বছরের এখন পর্যন্ত সাত বছরে কেবল বান্দরবানেই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সাত সেনা সদস্যসহ ৫২ জন পাহাড়ি-বাঙালি। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়েও এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মতভেদ, বিরোধিতা। চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এখনো সভা-সমাবেশে ব্যস্ত পাহাড়ি-বাঙালি সংগঠনগুলো। বিশেষ করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে এই চুক্তি নিয়ে বিরোধিতা এখনো প্রকট।
পাহাড়ে খুন, অপরণ ও চাঁদাবাজিতে জড়িত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাহাড়ে যতগুলো গ্রুপ বা উপগ্রুপ রয়েছে, কোনোটিই জনগণের তৈরি হয়নি। বরং বিশেষ সমর্থন দিয়ে এগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের ওপর থেকে বিশেষ সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা।’
এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়িদের অধিকার সংরক্ষণ করা হলেও বাঙালিদের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মো. মজিবর রহমানের। একে পাহাড়ে শান্তি না ফেরার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেকোনো চুক্তির মাধ্যমে দুপক্ষকেই লাভবান করে দিতে হয়। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে একটি পক্ষকে (পাহাড়ি সম্প্রদায়) লাভবান করা হয়েছে, অন্য পক্ষকে (বাঙালি) ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এর ফলে পাহাড়ে এখনো অশান্তি বিরাজ করছে।’
তবে পাহাড়ি নেতাদের দাবি, চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হলেও তা এখনো অকার্যকর। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে নির্বাচন নেই। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন অকার্যকর। এসব কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব হয়নি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের নামে কালক্ষেপণ করেছে দাবি করে বান্দরবান সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি সেনাবাহিনীর সাবেক সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার অং চ মং মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন হলে সশস্ত্র গ্রুপগুলো আর কোনো অজুহাতে পাহাড়ে সক্রিয় থাকতে পারত না। ফলে চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়াও পাহাড়ে শান্তি না ফেরার পেছনে অন্যতম কারণ।’
ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) বান্দরবান শাখার সভাপতি উবামং মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের নানা গোষ্ঠী থেকেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে নানাভাবে সংকট তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলো নানা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।’
পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। শান্তিকে স্থায়ী রূপ দিতে হলে সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতের ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন তারা। আরও বলছেন, রাজনৈতিক সরকারগুলো নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ থেকে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে টালবাহানা করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এই সরকারের কাছে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করছেন তারা।
পিসিজেএসএস কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্তর্বতীকালীন সরকার চুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে বলেই সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিক চুক্তির বর্ষপূর্তি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে আমরা চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আশাবাদী।’
সারাবাংলা/টিআর
ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জনসংহতি সমিতি জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পিসিজেএসএস প্রসিত খীসা বান্দরবান রাঙ্গামাটি শান্তি চুক্তি সন্তু লারমা