Monday 02 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৭ বছর
পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায় পাহাড়িরা, বাঙালিরা চায় সংশোধন

জসিম মজুমদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:১২ | আপডেট: ২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৪১

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও শান্তিবাহিনীর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে সই করেন। ছবি: সংগৃহীত

খাগড়াছড়ি: পার্বত্য চুক্তি তথা শান্তিচুক্তির ২৭ বছর আজ। দুই যুগের বেশি সময় পার গেলেও চুক্তি নিয়ে অসন্তোষে আছেন পাহাড়ি-বাঙালি সবাই। একদিকে, শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চায় পাহাড়িরা। অন্যদিকে, পার্বত্য চুক্তি বাঙালিদের জন্য অসম্মানজনক এবং এর অনেক ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তুলে ধরে সংশোধন চায় বাঙালিরা।

পাহাড়কে শান্ত রাখতে এবং পাহাড়ি ও বাঙালিদের জীবনমানসহ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য পার্বত্য চুক্তি করে সরকার। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। সরকারের পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরপে সন্তু লারমা চুক্তিতে সই করেন।

বিজ্ঞাপন

পরে অস্ত্র সমর্পণ করে সন্তু লারমাসহ ১৯৪৭ অস্ত্রধারী, যারা পিসিজেএসএসের সশস্ত্র গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সদস্য ছিল। চুক্তির আলোকে সংশোধন করা হয় স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন। তা পরিবর্তিত হয়ে নতুন নামকরণ হয় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন-১৯৮৯। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে দুয়েক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিভাগ ছাড়া প্রায় বাকি সব বিভাগই ন্যাস্ত করা হয় জেলা পরিষদের হাতে। নিয়ন্ত্রণের জন্য তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়।

জাতীয় গণঅধিকার পরিষদের সদস্য ও সাবেক গুইমারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উশ্যেপ্রু মারমা বলেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির সুফল জনগণ পায়নি। জনগণ হতাশ। চুক্তি নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। যেমন এ পর্যন্ত জেলা পরিষদ শুধু একবার নির্বাচিত পরিষদ পেয়েছে। বাকি ২২ বছর ধরেই চলেছে সরকারের মনোনীত অযোগ্য, অথর্ব ও অগ্রহণযোগ্যদের দিয়ে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন না করে, অন্তবর্তী পরিষদের নামে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পুনর্বাসন সেন্টারে পরিণত হয়েছে জেলা পরিষদ।’

বিজ্ঞাপন

তিনি জানান, অন্তবর্তী সরকার গত ৭ নভেম্বর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করেছে। খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বিশ্বস্ত জিরুনা ত্রিপুরা, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী বীর বাহাদুরের ঘনিষ্ঠ থানজামা লুসাইকে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি দীপংকর তালুকদারের সহযোগী ও দুর্নীতিবাজ কাজল তালুকদারকে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তার দাবি, চুক্তি অনুযায়ী নির্বাচন হলে এরা কখনোই চেয়ারম্যান হতে পারতো না। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা পার্বত্য এলাকায় সব সরকারি দফতরের প্রধান, অর্থাৎ বিসিএস ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রক। দেশ ও দুনিয়া সম্পর্কে না জানা, দুর্নীতিবাজ, আওয়ামী লীগের দোসররা চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। এরা চুক্তির উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কেও জানে না। এসব জায়গায় সংস্কার না হলে চুক্তির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাহত হবে।

সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক চুক্তির বিভিন্ন ধারাগুলোর বিষয়ে উশ্যেপ্রু মারমা বলেন, ‘এগুলো সময়ের দাবি। আলোচনা হতে পারে এবং বর্তমান অন্তবর্তী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনগুলো সংস্কার বা রিফ্রম করার উদ্যোগ নিতে পারে।’

খাগড়াছড়ি জেলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধি রবি শংকর তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘শান্তি চুক্তির ফলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভ করে। যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে শান্তিচুক্তির ওপর ভর করে জেলা পরিষদ গঠন হয়েছে, তা এখনো অর্জিত হয়নি। বর্তমান জেলা পরিষদ পূনর্গঠনে শাসকগোষ্ঠীর মতামতই প্রতিফলিত হয়েছে, জনমতের প্রতিফলন হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ পরিষদ চায় জনগণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি, স্থানীয় পুলিশ নিয়োগের ক্ষমতা চুড়ান্ত হয়নি। পাহাড়ে সমস্যা বেড়েছে। পাহাড়ের জনগণ হতাশ। শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি তাদের।’ চুক্তির সঙ্গে সংবিধানের সাংঘর্ষিক ধারা গুলোর বিষয়ে তিনি বলেন চুক্তি সম্পাদনকারী পিসিজেএসএস এর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে সরকার। রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে চুক্তির আলোকেই আলোচনা হতে পারে এবং করণীয় ঠিক করা যেতে পারে।’

পিসিজেএসএস কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান জুপিটার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের যে কমিটমেন্ট শান্তি চুক্তিতে ছিল, তা গত ২৭ বছরেও অধরা। পাহাড় এখনো অশান্ত, উন্নয়ন এখনো পশ্চাদমুখী। শান্তিচুক্তির ফলে যে সুফল পাওয়ার কথা-তা হতে এখনো বঞ্চিত। গত সরকার ক্ষমতার মসনদে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের রক্ষাকবচ তথা চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’

তার দাবি, চুক্তির ৭২টি শর্তের মধ্যে মাত্র ২৫টি পূর্ণাঙ্গ ও ১৮টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। এখনো ২৯টি শর্ত বাস্তবায়ন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ণ দাবি করেন এই নেতা।

চুক্তির বিতর্কিত ধারাগুলোর সংশোধনের দাবি বাঙালিদের

পার্বত্য চুক্তি বাঙালিদের জন্য অসম্মানজনক, অবমাননাকর, মৌলিক ও মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন বাঙালি নেতারা। তারা পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিতে পার্বত্য চুক্তির বেশ কিছু ধারা সংশোধনের দাবি জানান।

খাগড়াছড়ি জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী আবদুল মোমিন সারাবাংলাকে জানান, চুক্তি অনুযায়ী করা জেলা পরিষদ আইনের ২(ক) ধারায় বাঙালি জনগণকে অউপজাতীয় হিসেবে আইডেনটিটি দেওয়া সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদের সাথে, ২(কক) ও ১৭ (১) ধারা অনুযায়ী বাঙালিরা ভোটার হতে হলে বৈধ জমি ও নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকার বিধান সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদের সাথে, ৩১, ৩২ ও ৬২ ধারামতে বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার প্রদান সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদের সাথে, ৫৮ ও ৭১ ধারামতে চেয়ারম্যান বা তার প্রতিনিধির লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোন আদালত মামলা নিতে না পারা বা পরিষদের কারো বিরূদ্ধে মামলা করতে হলে এক মাস সময় দিয়ে নোটিশ প্রেরণ সংবিধানের ২৭, ৩১ অনুচ্ছেদের সাথে অসামঞ্জস্য বিধায় সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাতিল করতে হবে।’

পুরো আইনটি বাঙালিদের জন্য অসম্মান ও অবমাননাকর উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আইনের চোখে সকল নাগরিকের মর্যাদার সমতা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে।

পার্বত্য নাগরিক পরিষদের, খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার লোকমান হোসেন সারাবাংলাকে বলেন ‘১৯৯৭ সালে সরকার এক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিতর্কিত চুক্তি করেছে। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী খাগড়াছড়িতে বাঙালি ও পাহাড়ি জনসংখ্যা হচ্ছে ৫১.০৭ : ৪৮.৯৩। অথচ পরিষদে বাঙালি ও পাহাড়িদের প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে ১০:২৪। চেয়ারম্যান পদও পাহাড়িদের জন্য সংরক্ষিত। চুক্তি আরেক ফসল আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পাহাড়ি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পাহাড়ি, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পাহাড়ি। সব জায়গায় যদি নেতৃত্বে পাহাড়িরাই থাকে- তাহলে অর্ধেকেরও বেশি বাঙালি কোথায় গিয়ে সাংবিধানিক অধিকার চাইবে। চুক্তির যেসব ধারা অসাংবিধানিক তা বাতিলেরও দাবি জানান বাঙালি এই নেতা।’

অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী চৌধুরী নামের আরেক বাঙালি নেতা বলেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার যেদিন খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তিবাহিনীর কাছে থেকে অস্ত্র জমা নেয়, সেদিনও একদল পাহাড়ি বিক্ষোভ করছিল। তার মানে সরকার যে পিসিজেএসএস’র সঙ্গে চুক্তি করেছে- সেটি পাহাড়ের সকল জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেননি। চুক্তিতে সব পাহাড়ির মতামত যেমন ফুটে ওঠেনি, তেমনি অর্ধেকেরও বেশি বাঙালি জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ও অধিকারের কথা চিন্তাও করেনি তখনকার সরকার।’

পাহাড়ে বর্তমানে চারটি আঞ্চলিক দল আছে। পিসিজেএসএস, ইউপিডিএফ, পিসিজেএসএস (সংস্কারপন্থী) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামক দলগুলো চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে এক নয়। অন্যদিকে, পাহাড়ের অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠী বাঙালিদের মর্যাদা, সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার, জনসংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব এই চুক্তিতে অস্বীকৃত। পুরো চুক্তিটিই একপেশে এবং অনেক ধারাই দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে চুক্তিটি বাতিল অথবা বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে সংশোধন করতে হবে।

যা বলছেন জেলা প্রশাসক

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চুক্তির পর ১৯৯৮ সালের ২, ১৬ ও ২২ ফেব্রুয়ারি সন্তু লারমাসহ ১৯৪৭ জন শান্তিবাহিনীর সদস্য আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এছাড়া ছয় দফায় ১২ হাজার ৩২২ পরিবারের ৬৩ হাজার ৬৪ সদস্য ভারত থেকে নিজ বাড়িতে ফিরেছে এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ৬ সেপ্টেম্বর আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর ও প্রতিমন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে। ১৯৯৮ সালের ৬ মে চুক্তির আলোকে কার্যক্রম শুরু করে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো।’

তিনি জানান, ৩৩টি হস্তান্তরযোগ্য সরকারি দফতরের মধ্যে ৩০টি সরকারি দফতর ন্যাস্ত করা হয় জেলা পরিষদগুলোর হাতে। চুক্তির বেশিরভাগ শর্তই পূরণ হয়েছে। ৭২টি শর্তের মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন, বাকি ধারাগুলোর বেশিরভাগের আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার খুবই আন্তরিক। সকলের সহযোগিতা পেলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে করেন জেলা প্রশাসক সহিদুজ্জামান।

সারাবাংলা/পিটিএম

২৭ বছর খাগড়াছড়ি পার্বত্য শান্তি চুক্তি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর