শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন
উন্নয়ন বাজেটের ৪০% তছরুপ, ৮৫% সম্পদ ১০ শতাংশ মানুষের ভোগে
২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:১৪ | আপডেট: ২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:২২
ঢাকা: আওয়ামী লীগের সবশেষ ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশই তছরুপ হয়েছে বলে উঠে এসেছে অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়েছে, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করছেন মোট সম্পদের ৮৫ শতাংশ।
সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সম্মেলন কক্ষে শ্বেতপত্র কমিটির সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সংবাদ সম্মেলনে কমিটির বাকি সদস্যরাও সংক্ষেপে প্রতিক্রিয়া জানান।
এর আগে রোববার (১ ডিসেম্বর) দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করে। গত ৫ অগাস্ট সরকার পতন ও ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৮ অগাস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে ১২ সদস্যের এই কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়।
রোববার শ্বেতপত্র কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তরের সময় জানায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরে সময়ে গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ চলতি অর্থবছরের জন্য পাস হওয়া দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বাজেটের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ।
আরও পড়ুন- প্রতি বছর ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা পাচার: শ্বেতপত্র কমিটি
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে প্রতিটি খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। সংবাদ সম্মেলনে ড. এ কে এনামুল হক বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যতটা না উন্নয়ন, তার চেয়ে বেশি লুটপাটের জন্য নেওয়া হয়। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ ব্যয় তছরুপ বা লুটপাট করা হয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য ড. আবু ইউসুফ বলেন, রাজস্ব বোর্ড যে পরিমাণ টিন সার্টিফিকেট থাকার দাবি করে, সে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় না। এমনকি কেউ মারা গেলে সেই সার্টিফিকেট বা নম্বর কী হবে, তার কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া নেই। রাজস্ব বোর্ড সেটি কমিটিকে দিতে পারেনি। কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা খাতকে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার কোনো সঠিক কাঠামো নেই।
কমিটির সদস্য ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসনের জন্য মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে। অভিবাসনের মাধ্যমেও অর্থপাচার হয়েছে।
ড. ইমরান মতিন বলেন, ১০ শতাংশ মানুষের কাছে ৮৫ ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত। টোকা দিলে যে দারিদ্র্য বিমোচন শেষ হয়ে যাবে, সেটিকে কার্যকর উদ্যোগ বলে না।
ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব টাকা লোপাট করা হযছে। পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে সেই বোঝা থেকে গেল।
করণীয় তুলে ধরে কমিটির সদস্য ড. সেলিম রায়হান বলেন, লুটপাটের মাধ্যমে বেশির ভাগ খাতকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। যেসব খাতে সংস্কার দরকার, সেখানে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে।
শ্বেতপত্র কমিটির আরেক সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সরকারি তথ্য-উপাত্তে বড় গলদ আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধা লেনদেনের জন্য প্রভাবশালীদের চাপে ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে এসব তথ্য-উপাত্তে গোলমাল করা হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন, ৩০ অধ্যায়ের ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে কীভাবে ক্রোনি পুঁজিবাদ অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে, কীভাবে তারা নীতি প্রণয়নকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাদের চাপে দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করছেন।
দেবপ্রিয় আরও বলেন, চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো কাঠামো। এর উৎস ২০১৮ সালের নির্বাচন। পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়েছে, সেখানে স্বচ্ছতার জায়গা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের জবাবদিহিতা নষ্ট করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘ এখনো মনে করছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই।
স্থিতিশীলতায় জোর দিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির এই প্রধান বলেন, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম করা যাবে না। পরবর্তী জাতীয় বাজেট আসার আগে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে বর্তমান সরকার কী কী উদ্যোগ নেবে, সেগুলোকে স্পষ্ট করতে হবে। আরও দায়বদ্ধতা আনতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই সরকার পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকবে না। তবে অন্তত আগামী দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা সামনে থাকতে হবে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর
অর্থনীতি উন্নয়ন প্রকল্প ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য লুটপাট শ্বেতপত্র কমিটি