ঢাকা: ‘ভারত যদি যুদ্ধ করতে চায় বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াবে’— বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
সোমবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
রিজভী বলেন, ‘‘ভারতের সাধারণ জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু চরম উগ্রবাদী বিজেপি যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক প্রতিটা মানুষ এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব-সম্মান আত্মমর্যাদা রক্ষায় রুখে দাঁড়াবে। দুর্জয় এ বাংলাদেশ কখনোই মাথা নোয়াবে না।’’
তিনি বলেন, ‘‘কলকাতা উপ-হাইকমিশন, আগরতলা সহকারী হাইকমিশনে হামলা, মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে হাঙ্গামা এবং ধারাবাহিক চরম উসকানিমূলক বক্তব্য ও সীমাহীন অপপ্রচারে বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হিংস্র আগ্রাসী হস্তক্ষেপের ঘটনা ও ভারতের বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ছেলেরাও মিছিল নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।’’
রিজভী বলেন, ‘‘এখন যুক্তিবিমূখ কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাদপদ চিন্তাধারার রাজনীতিবিদরা ভারত শাসন করছে। ক্ষমতার নেশায় আচ্ছন্ন ভারতের সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে আশকারা দিচ্ছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী অপরাধপ্রবণ জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোকে। মিথ্যা বলাই এদের রাজনৈতিক ইশতেহার। ওদের মিথ্যা কথা চেঁচানোর রেওয়াজ দীর্ঘদিনের।’’
তিনি বলেন, ‘‘ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ভারত কখনোই সহাবস্থানের লিটেরেসি আয়ত্ব করেনি। যে কারণেই আশপাশের দেশগুলোর পরিচিত পরিপার্শ্বকে উপেক্ষা করে আগ্রাসনের পথ ধরে।’’
রিজভী বলেন, ‘‘বিশ্বের সব দেশেই রয়েছে ধর্মের নামে অথবা বর্ণের নামে উগ্রবাদীদের দৌরাত্ম। তারা সব দেশ, জাতি-গোষ্ঠী, সব সমাজ, সব ধর্মের জন্য চরম ক্ষতিকর। দুঃখের বিষয় হল, কিছু ধর্মীয় উগ্রবাদী ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ভারতের চরম সাম্প্রদায়িকক সংগঠন বিজেপির প্রত্যক্ষ মদদ ও উসকানিতে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের আহবান এই উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করুন।’’
তিনি বলেন, ‘‘সিলেটের সুতারকান্দি স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ দিয়ে রীতিমতো পদযাত্রা করে হিন্দু উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা সরাসরি আমাদের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী বিজেপির উসকানিমুলক তৎপরতারই অংশ। তার আগে উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা বিজেপি সরকারের উসকানিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নিস্ক্রিয় উপস্থিতিতে আগরতলার কুঞ্জবনে অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে নারকীয় হামলা, জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে আগুন, পতাকার খুঁটি ভাঙচুর, সহকারী হাইকমিশনের অভ্যন্তরের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। আগরতলায় কূটনৈতিক মিশনের ওপর এহেন নজিরবিহীন হামলা ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশন, ১৯৬১ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’’
রিজভী বলেন, ‘‘ভারত সরকার হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও, অতীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের আগ্রাসী হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, যা আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ভারতের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী আমাদের হাইকমিশনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সহায়তা চাওয়া।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুদের বলব, আপনাদের বন্ধুত্ব তো শেখ হাসিনার সঙ্গে। সেই বন্ধুত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে প্রকাশ্যে শত্রুতায় নেমেছেন সেটা সৎ প্রতিবেশী সূলভ আচরণ নয়। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে আপনাদের বন্ধু শেখ হাসিনা আপনাদের কাছে আশ্রয় পেয়েছে। তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। মনে রাখবেন বাংলাদেশ লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে দিল্লীর দাসত্ব করতে নয়। যে সেবাদাসী হতে চেয়েছিলেন সেই দাসী এখন আপনাদের পদতলে।’’
রিজভী বলেন, ‘‘ক্ষমতা হারিয়ে বিতাড়িত হওয়ায় হাসিনার চেয়ে বেশি পাগল হয়ে গেছে ভারতের বিজেপি সরকার ও উগ্রবাদীরা। মরিয়া হয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ান হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীদের আরেক ছদ্মবেশী শিখন্ডি মমতা ব্যানার্জি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী পাঠাতে বলছে। প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত কিন্তু শত্রুতা করতে চাইলে সেটা বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না। নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবেন না।’’
তিনি বলেন, ‘‘ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেসব নিয়ে দেশটির কোনো সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের মাষ্টারপ্ল্যানের পরিস্থিতিতে তারা অযাচিত উদ্বেগ-উগ্রতা প্রকাশ করছে। যা সীমা অতিক্রম করেছে। ভারতের ভূমিকা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। তাদের নিজেদের দেশে মুসলিম খ্রিস্টান নিম্নবর্নের দলিত হিন্দু শিখসহ সংখ্যালঘুদের কোনো নিরাপত্তা নেই। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অস্থির।’’
রিজভী বলেন, ‘‘বিশ্ববাসী জানে হিন্দুত্ববাদী ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতনের আঁতুরঘর। বিশ্বের ১ নাম্বার বর্ণবাদী দেশ ইন্ডিয়া। সে দেশে মুসলমান নাগরিকদের ওপর নানা জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। সংখ্যালঘু মুসলমানের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে সংখ্যালঘুদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কয়েক দিন আগেও উত্তর প্রদেশের উপ-নির্বাচনে পাঁচজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যে ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতন রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পন্ন করতে অভ্যস্ত তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাল্পনিক অভিযোগ তুলেছে।’’
ভারতের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের কাশ্মীরের কী অবস্থা? আপনাদের আসামের কী অবস্থা? আপনাদের মনিপুরের কী অবস্থা? পাঞ্জাবের শিখদের কী অবস্থা? কানাডা তাদের দেশে আপনাদের নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আপনারা শত শত মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বানান। গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে নিরাপরাধ মানুষ পিটিয়ে মারেন। আগে নিজের দেশ সামলান। শান্তিরক্ষী বাহিনী আপনার দেশ ইন্ডিয়াতে মোতায়েন করেন। খুব দরকার, বিশেষ করে কাশ্মীরে আর আসামে ও মনিপুরে।’’
রিজভী বলেন, ‘‘ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক দশকের শাসনামলে দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার ক্রমশ কমে আসছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) মুসলিমবিরোধী বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশটির একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করেছে মোদি সরকার। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে নির্মিত হয়েছে রামমন্দির। একাধিক রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুছে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে মোগল আমলের বিভিন্ন নাম ও স্মৃতিচিহ্ন।’’
তিনি বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে সেখানকার মুসলিমরা প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ভারতে গত লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদির ৬৩ শতাংশ ভাষণ ছিল ঘৃণা উদ্রেককারী। ১৭৩টির মধ্যে ১১০টি ভাষণে ‘ইসলামভীতি’নিয়ে মন্তব্য করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।’’
রিজভী আরও বলেন, ‘‘বাংলাদেশকে নিয়ে ননসেন্স বক্তৃতার ধারাবর্ষণসহ বাংলাদেশের ভেতরে অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত। তারা পরিকল্পিতভাবে হিম ঠান্ডা ত্রাস আর আতঙ্কের স্রোত নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও জনসমাজে। তারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার সর্বগ্রাসী আগুনে সবকিছু ছাই করে মানুষ, সংস্কৃতি, সভ্যতা ধ্বংস করতে চায়।’’