জাতীয় সংকটে সরকারের পাশে, জনআকাঙ্ক্ষা ও গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন
৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০৪
ঢাকা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ হতে চলল প্রায় চার মাস। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকার গঠনের পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। দলগুলো সংস্কারের পক্ষে থাকলেও সমান্তরালে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যসহ অন্য ইস্যুগুলোতেও সরকারের সমালোচনা করছে তারা।
এর মধ্যেই সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাবেক ইসকন নেতার গ্রেফতার ইস্যু ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে পর্যন্ত উত্তেজনা ছড়িয়েছে। জাতীয় এই সংকটে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিল সরকার, দলগুলোও সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয় জানিয়েছে।
জাতীয় ইস্যুতে একজোট হলেও নির্বাচনসহ জনগণের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে সরকারকে ছাড় দিতে রাজি নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এসব ইস্যুতে সরকারের বিচ্যুতি দেখলে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার কথাই বলছেন দলগুলোর নেতারা। তবে এর জন্য বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনসহ প্রথম ধাপে গঠন করা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশনগুলোকে প্রতিবেদন জমা দিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় তারা এসব সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব বা সুপারিশ জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, তার ওপর ভিত্তি করে তারা নিজেদের কর্মকৌশল নির্ধারণ করবেন। এসব সুপারিশ জনবান্ধব ও গণতান্ত্রিক না হলে নতুন বছরের শুরু থেকে দৃশ্যমান আন্দোলন গড়ে তোলার আভাস দিয়েছেন তারা।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রথম ও প্রধান দাবিই হলো নির্বাচন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছেন। সংবিধানসহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রসংস্কারের কাজকে চলমান প্রক্রিয়া অভিহিত করে তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকারই চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রসংস্কারের কাজ করবে।
গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের অভিমত, সংস্কার ও নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত সংলাপ আয়োজন করা। সরকারকে জাতীয় সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগ নিতে অনুরোধও জানিয়েছেন তিনি।
এর মধ্যেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ, সাবেক ইসকন নেতা গ্রেফতার, ভারতে বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো, ভারতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ইত্যাদি ঘটনা নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছিলেন বৈঠকে। সেখানে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এখন আমাদের পুরো বিশ্বকে বলতে হবে যে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’ রাজনৈতিক দলগুলোও জাতীয় সংকটের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয় জানান।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা সরকারকে সমর্থন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একই সুরে কথা বলেছেন। একাধিক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, দেশ ও মানুষের স্বার্থে আমরা রাজনীতি করি। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সবার আগে। বিভিন্ন তৎপরতা থেকে এটি স্পষ্ট, একটি গোষ্ঠী বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে ফায়দা লুটতে চায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনও রয়েছে। এ জাতীয় সংকটকালে ঐক্য থাকার বিকল্প নেই। জাতীয় ইস্যু আমরা একজোট হয়ে মোকাবিলা করব।
একই সঙ্গে ভোট ও গণতান্ত্রিক যে প্রক্রিয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন হয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এবং জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আমরা রাজপথেও আন্দোলন করব— বলেন নেতারা।
জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহামুদর রহমান মান্ন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের কথা তো গণহারে আমরা বলে যাচ্ছি। সরকার সংস্কারের কথা বলছে। সব সংস্কার তো তারা করতে পারবে না। তাছাড়া এখন দেশে যেসব সমস্যা আছে, নির্বাচিত সরকার এলে অনেক সমস্যাই কমে যাবে। এখন ডিসেম্বরে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। দেখা যাক তারা কী প্রতিবেদন দেয়। সেগুলো দেখে আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, “জাতীয় সংকটে আমরা সরকারের পাশে রয়েছি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আমরা সেটি স্পষ্ট বলেছি। তবে সরকারের কাছেও আমাদের প্রত্যাশা, তারা রাজনীতিবিদ ও জনগণের কণ্ঠস্বর বুঝতে পারবে। সরকারের উচিত হবে ডিসেম্বরে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়লেই নির্বাচনি পথনকশা প্রকাশ করা। আমরা তো নির্বাচন নিয়ে সরকারকে নানাভাবে বলে আসছি। আমি মনে করি, ‘ইশারাই কাফি’ হবে।”
সংস্কার প্রতিবেদনের ওপর পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ভর করছে বলে জানালেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সংস্কার কমিশন সরকারকে প্রস্তাব দেবে। এর মধ্যে যদি দেখি সংস্কার কমিশন এমন প্রস্তাব করেছে যা সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যথাযথ নয় কিংবা সরকার নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেরি করছে, তখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। এখন আমরা যেমন বিবৃতির ভাষায় কথা বলছি, তখন অন্যভাবে কথা বলব। আমরা সরকারের ঘোষণার অপেক্ষায় আছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা সারাবাংলাকে বলেন, নানা প্রশ্ন থাকলেও সরকারকে এখন পর্যন্ত আস্থায় রেখেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে দিন শেষে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে সরকার কতটুকু আন্তরিক, তার ওপর নির্ভর করবে আস্থার পরিমাণ। ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেওয়ার পরও যদি সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপের দিকে না হাঁটে, তাহলে জানুয়ারি থেকেই রাজনীতির মাঠ ‘গরম’ হয়ে উঠবে বলে জানাচ্ছেন তারা। জাতীয় ইস্যুতে ঐক্য আর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন একঙ্গেই চলবে বলে জানান তারা।
এদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি, রব) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন স্বপন অবশ্য অন্য দলগুলোর সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত জানালেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেকে চাচ্ছেন শুধু নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করেই নির্বাচন দিতে। তাদের সঙ্গে আমাদের মতের পার্থক্য আছে। আমরা সার্বিকভাবে সংস্কার করেই নির্বাচন চাই।’
তবে সার্বিক সংস্কারের জন্যও সরকার কতটুকু সময় নিচ্ছে, সেটি পর্যবেক্ষণে রাখবে জেএসডি। শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘সবাই যৌক্তি সময়ে নির্বাচন দাবি করছে। সেই যৌক্তিক সময় অবশ্যই পাঁচ বছর নয়। নির্বাচন দিতে যদি সরকার অনেক বেশি সময় নিতে চায়, সেটি কেউই মেনে নেবে না।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচন সরকারবিরোধী আন্দোলন সংস্কার কমিশন সংস্কার প্রতিবেদন