‘শহিদ আলিফের রক্তের মধ্য দিয়ে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে’
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:০৬ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:০৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের রক্তের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা এসেছে ও বাংলাদেশকে রক্ষায় গণজাগরণ তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আমাদের ভাই, সহকর্মী, চট্টগ্রাম বারের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের কবর জেয়ারত করতে এসেছিলাম। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে, কষ্টের সাথে, বেদনাহত হৃদয়ে আপনাদের বলতে চাই, যেভাবে, যে প্রক্রিয়ায়, যে কারণে, যে নৃশংসতার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সহকর্মীকে হারিয়েছি, যেভাবে সাইফুল ইসলাম আলিফকে হারাতে হয়েছে, আমরা বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনে মুক্তি এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করেছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। অনেকের মধ্যে আশঙ্কা ছিল যে, বাংলাদেশে বিপ্লবের ফসল ভেসে যাচ্ছে কী না। শহিদ আলিফের রক্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা এসেছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সাবভৌমত্ব রক্ষার জন্য যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে, তাতে দেশদ্রোহীরা ভেসে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দু’য়েক মাসে বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। আমরা একটা র্যাডিকেল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। একটু সময় লাগবে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার যে স্বপ্ন, বিশ্বাস আমরা সেটাকে ধারণ করেই এগিয়ে যাব। আমরা ন্যায়বিচারের দ্বার উন্মোচন করব।’
বিশেষ দেশ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে বন্ধন, সেই বন্ধনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি বিশেষ গোষ্ঠী, বিশেষ মহল, বিশেষ দেশ প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে বলে। আমার গাড়িতে ছিলেন সুব্রত চৌধুরী (সিনিয়র আইনজীবী ও গণফোরাম নেতা)। তিনি একটি টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই, কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত নেই, কোনো সাম্প্রদায়িক অসহিঞ্চুতা নেই।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এখানে দেখেন, হিন্দুদের দুর্গাপূজার ছুটি একদিন বেশি দেওয়া হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশে দেখেন, সেখানে মুসলমানদের ঈদের কোনো ছুটি দেওয়া হয় না। আপনি লন্ডনে যান কিংবা অন্য কোনো দেশে যান, সেখানে দেখবেন ঈদের জন্য কোনো ছুটি দেওয়া হয় না। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের মানুষ এতটাই সহনশীল যে, আমরা সব ধর্মের উৎসবকে বাংলাদেশের মানুষের উৎসবে পরিণত করেছি। দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও সেটা বাংলাদেশের সকল মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিজু উৎসব পাহাড়িদের উৎসব হলেও সেটা পাহাড়ি-বাঙালি সবার উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঈদ বাংলাদেশের মুসলমানদের উৎসব হলেও এখানে সব ধর্মের মানুষ ঈদের ছুটি ভোগ করেন, ঈদ সবার উৎসবে পরিণত হয়েছে। আমরা এমন একটি দেশ, এদেশে এখনও মসজিদে আজানের সময় মন্দিরের ঘণ্টা বন্ধ হয়ে যায়, মন্দিরে ঘণ্টা বাজানোর সময় মসজিদে আজান হয় না। আমরা সেরকম একটি সমাজ চাই এবং পেয়েছি।’
আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা জানেন, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের প্রায় ৭০০ মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। চার হাজারের ওপর মানুষ বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। বিএনপির ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছে, অন্যান্য রাজনৈতিক দল তো আছেই। এসব মামলার অধিকাংশই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাদী হয়ে করেছিল। আমরা যে দুঃসময় পার করে এসেছি, এমন দুঃসময়ের মুখোমুখি আর হতে চাই না বলেই বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতার ‘গণহারে মিথ্যা মামল‘ দায়ের নিয়ে এক প্রশ্নের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মিথ্যা মামলা হচ্ছে, এটা আমরা অনুধাবন করছি। অনেক স্বার্থান্বেষী মহল অনেক নিরীহ মানুষকেও বিচারের মুখোমুখি করছে, মামলার আসামি করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মামলা হওয়া মানেই গ্রেফতার নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন অনুধাবন করেছে মিথ্যা মামলা হচ্ছে, সাথে সাথেই সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। একটি মামলায় ৩০০ জন আসামি হলেও দেখবেন ওই মামলায় ৩০ জনও গ্রেফতার হয়নি। এটা সরকারের কমিটমেন্টের অংশ। আমরা বিষয়গুলো আরও প্রায়োরিটি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘গত সরকারের থেকে এ সরকারের আমলে মিথ্যা মামলার পার্থক্যটা হলো, গত আমলে মিথ্যা মামলা বা গায়েবি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ বাদী হয়ে। মৃত ব্যক্তিকে আসামি করেছে। পঙ্গুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে যার দুই হাত নেই। যিনি হজে আছেন তার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে, এটা পুলিশ বাদী হয়ে করেছে। কিন্তু এ আমলে এখন পর্যন্ত পুলিশ বাদী হয়ে এ ধরনের মামলা করেছে, এমন কোনো তথ্য যদি আপনাদের কাছে থাকে, আমাদের কাছে পাঠাবেন, আমরা যা ব্যবস্থা নেওয়ার অবশ্যই নেব। এখন একটি পরিবারের মা বা ভাই যদি একটি মামলা করেন, সেখানে যদি ৩০০ কিংবা ৫০০ জনকে আসামি করা হয়, তাহলে পুলিশের তো কিছু করার থাকে না। পুলিশের কাছে কিংবা আদালতের কাছে যখন একটি মামলা নিয়ে যাওয়া হবে, তখন প্রাথমিকভাবে তারা মামলাটা কগনিজেন্সে নিতে বাধ্য।’
তিনি বলেন, ‘এ মামলাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলে যাবে। সেখানে যাচাইবাছাই করে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর বাইরেরগুলো পুলিশ যাচাইবাছাই করে ফাইনাল রিপোর্ট দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আশ্বস্ত করছি, আমরা ন্যায়বিচারের দ্বার কখনো রোধ করবো না। ন্যায়বিচারের দ্বার, মানবাধিকারের দ্বার, মৌলিক অধিকারের দ্বার আমরা সবসময় উন্মুক্ত রাখবো।’
আলোচিত ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ও আইনজীবী হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম আলিফ যেভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তা উদঘাটন করেছে মিডিয়া। মিডিয়ার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব জেনেছে। চিন্ময় দাসের বিষয়টা এখনও তদন্তাধীন আছে। মিডিয়ার মাধ্যমে তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেকরকম বক্তব্য এসেছে। বিষয়গুলো তদন্তাধীন আছে।’
বিগত আমলে ‘ফ্যাসিবাদের দোসরদের’ চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব কুক্ষিগত করে রাখা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। যদি কেউ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে, কেউ যদি সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায়, আশা করি প্রশাসন তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানের চেয়ে ক্ষমতাবান আর কেউ ছিলেন না। মানুষের দেশপ্রেমের কাছে, মানুষের ঐক্যবদ্ধতার কাছে ভেসে গেছে।’
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব অন্তবর্তী কমিটির আহ্বায়ক জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের সভাপতিত্বে ও সদস্য গ্লোবাল টেলিভিশনের ব্যুরো প্রধান গোলাম মাওলা মুরাদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন- অন্তবর্তী কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি ও সদস্য মুস্তফা নঈম, এনটিভির ব্যুরো প্রধান শামসুল হক হায়দরী, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিএমইউজে) সভাপতি মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ ও সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান এবং সদস্য ওয়াহিদ জামান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমদ, একাত্তর টেলিভিশনের ব্যুরো প্রধান সাইফুল ইসলাম শিল্পী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ প্রতিনিধি মিয়া মোহাম্মদ আরিফ এবং সাংবাদিক শাহনেওয়াজ রিটন এতে বক্তব্য রাখেন।
মতবিনিময়ের আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান লোহাগাড়ায় গিয়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের কবর জেয়ারত করেন। এসময় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরশাদুর রউফ, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট বদরুল আনোয়ার ছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/এইচআই
অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রাম