মিতু হত্যা মামলায় নতুন মোড়— ফাঁসানো হয়েছিল বাবুল আক্তারকে!
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:২৭ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৩৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আট বছর আগে গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যার শিকার মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলা নতুন মোড় নিচ্ছে। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাঁচ বছর পর স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিচারিক ও উচ্চ আদালতে দফায় দফায় জামিন চেয়েও পাননি বাবুল আক্তার। তিন বছর সাত মাস পর শেষ পর্যন্ত জামিনে কারামুক্ত হয়েছেন তিনি। বাবুলের কারামুক্তির আগে-পরের সময়ের জোর আলোচনা— মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুল আক্তারকে ফাঁসানো হয়েছিল!
জামিনে কারামুক্তির দিনে বাবুল আক্তারের আইনজীবীরা আবারও দাবি করেছেন, স্ত্রী হত্যা মামলায় ষড়যন্ত্র ও কাল্পনিক কাহিনী তৈরি করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। মিতু হত্যায় বাবুলকে গ্রেফতারেরও অনেক আগে থেকে তার বিরুদ্ধে সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন মিতুর বাবা ও বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। বাবুলের আইনজীবীদের দাবি, তাকেও বাবুল আক্তারের বিপক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছে।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান সাবেক এসপি বাবুল আক্তার। বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিটে তাকে পুলিশ পাহারায় রুপালি রঙের একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে বের হতে দেখা যায়। এ সময় তিনি কারও সঙ্গেই কথা বলেননি। বাবুলের স্ত্রী ইশরাত জাহান মুক্তাসহ পরিবারের আরও কয়েকজন তার সঙ্গে সদস্য ছিলেন। তারাও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি।
স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় গত ৩০ নভেম্বর হাইকোর্ট বাবুল আক্তারকে জামিন দেন। পরে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করেন। বুধবার বাবুল আক্তারকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন চেম্বার জজ বহাল রাখলে তার মুক্তিতে সব বাধা কেটে যায়।
বুধবার বিকেলে চট্টগ্রামে কারা ফটকে বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনাকে (বাবুল আক্তার) ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। উনার স্ত্রী খুন হয়েছেন। উনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উনাকে এ মামলায় আসামি করার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অস্বাভাবিক। কথিত এক গায়ত্রীর কথা বলে তাকে মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’
‘আমি তার ওই ডক্যুমেন্ট সংগ্রহ করে দেখেছি। গায়ত্রী বাবুল আক্তারের চেয়ে ১০ বছরের বড়। ভারতের তামিলনাডুতে তার বাড়ি। তার মুভমেন্টের যে রেজিস্ট্রার আমি দেখলাম, তিনি পৃথিবীর কোনো দেশে ১৫-২০ দিনের বেশি থাকেন না। খুব ব্যস্ত মানুষ। এখন মনে হয় নেদারল্যান্ডসে থাকেন। তাকে সাক্ষী করল না, বক্তব্যও নিল না। উলটো কাল্পনিক একটি কাহিনী দিয়ে বাবুল আক্তারকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে,’— বলেন আইনজীবী কফিল উদ্দিন।
তিনি আরও বলেন, ‘২০২১ সালে বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। উনার করা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে, সেটা দেখতে উনাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডেকে নিয়ে উনাকে বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছিল, যেভাবে জেলে এতদিন রাখা হয়েছিল। উনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১২ মে। পিবিআই উনাকে এনে আটক করে রেখেছিল ১০ মে থেকে। উনাদের আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ১০ থেকে ১২ মে পর্যন্ত বাবুল আক্তারকে আটক করে কেন রাখা হয়েছিল। তারা আমাদের বলেছিল, বাবুল আক্তার নাকি তাদের অতিথি হিসেবে ছিল।’
বাবুল আক্তারকে মামলায় জড়ানোই মূল লক্ষ্য ছিল উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, ‘মামলাটি পিবিআইয়ে যাওয়াটাই ছিল অস্বাভাবিক ব্যাপার। ওখান থেকেই ষড়যন্ত্রের শুরু। স্ত্রী হত্যায় উনি, উনার ছেলেমেয়ে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। তদন্তের সময় মিতুর মোবাইলের সিম উদ্ধার হয়েছে ভোলা থেকে। যার কাছ থেকে সিম উদ্ধার করা হয়েছে, রহস্যজনকভাবে সে লোককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে এ মামলার আসামি বা সাক্ষীও করা হয়নি।’
‘হত্যার সময় যে মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছে, তার চালককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু তাকেও মামলায় সাক্ষী ও আসামি কিছুই করা হয়নি। এভাবে সবসময় সব আসামিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাবুল আক্তারকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করা। উনারা সাকসেসফুলি এটা করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এগুলো অনেক সময় লাগবে। কীভাবে কী করেছে, তার অনেক কাহিনী আছে। বাবুল আক্তারের যে মামলা, সেটার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অস্বাভাবিক। রাতে সব সরকারি অফিস বন্ধ থাকে। কিন্তু ওই প্রতিবেদন রাতেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এরপর আরেকটি মামলা চালু হয়ে গেল। উনার শ্বশুর মামলা করলেন পাঁচলাইশ থানায়। ওসি (তদন্ত) মামলার ভার গ্রহণ করলেন। ভার নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা চলে গেল পিবিআইতে। সবকিছুই ছিল অস্বাভাবিক।’
বাবুল আক্তার চাকরি ফিরে পাবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী কফিল বলেন, ‘চাকরি তো পুনর্বহাল তার হবেই। জোর করেই তার পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়েছিল। উনি সঙ্গে সঙ্গেই তো আপিল করেছেন। তাকে নিয়ে বলা হয়েছিল, চাকরি ছাড়ো, না হয় তোমাকে শেষ করে দেবো। তিনি ভয়ে বাধ্য হয়ে চাপে পড়ে সেটা করেছিলেন, যদিও ওই সময় তার শ্বশুরের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে প্রতিবাদ করা হয়েছে। বাবুল আক্তারের শ্বশুরকে বিভিন্ন কারণে তার বিপক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য করা হয়েছে।’
‘বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর প্রকৃত খুনি যারা, তাদের পেয়েও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ছেড়ে না দিলে মিতু হত্যার রহস্য ও তার পেছনে যারা প্রকৃত কারিগর তারা চিহ্নিত হতো। এখন আর আদৌ হবে কি না, জানি না,’— যোগ করেন কফিল উদ্দিন।
প্রশাসনিক দ্বন্দেই বাবুলকে ফাঁসিয়েছিলেন বনজ?
প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের কারণে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার চক্রান্ত করে বাবুল আক্তারকে তার স্ত্রী হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন বলে দাবি করেছেন আলোচিত মিতু হত্যা মামলার আরেক আসামি এহতেশামুল হক ভোলা।
গত রোববার (১ ডিসেম্বর) বিকেলে বাবুল আক্তারের জামিন হবে— এমন খবর পেয়ে কারাগারের সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন তার স্বজনরা। কিন্তু আদালত থেকে জামিনের নথি পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় বের হতে পারেননি বাবুল আক্তার। সন্ধ্যা পর্যন্ত কারাফটকের সামনে অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে হয়েছিল স্বজনদের। বাবুল আক্তারের জামিন হবে শুনেই সেদিন কারা ফটকে এসেছিলেন এহতেশামুল হক ভোলা।
কারা ফটকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভোলা বলেন, ‘মূল ঘটনা হলো প্রশাসনিক দ্বন্দ্ব। রিয়াজউদ্দিন বাজারে সোনার চোরাকারবার নিয়ে একটা অপারেশন চালানো হয়েছিল। বনজ কুমার স্যার (সাবেক পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার) তখন তাকে বলেছিল, দেখে নেবে। তাই দেখে নিয়েছে আর কী!’
ভোলা বলেন, ‘আমার জানামতে, উনি খুব সৎ লোক। আমি অনেক আগে থেকে উনাকে চিনি। উনি কোনো ঘুষ-টুষ নিতেন না। আমি জানি না, উনি এটাতে (মিতু হত্যাকাণ্ড) জড়িত আছেন কি না, আল্লাহই ভালো জানেন। আমরা চাই, এই মামলাটা পূর্ণ সাক্ষ্যগ্রহণ হয়ে বিচার হোক। যারা জড়িত, তাদের বিচার হোক। আশা করি বর্তমান সময়ে এসে সুষ্ঠু বিচার পাব।’
এহতেশামুল হক ভোলাকে ২০১৬ সালের ২৮ জুন তার সহযোগী মনির হোসেনসহ গ্রেফতারের কথা জানায় পুলিশ। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি অস্ত্র উদ্ধার করার কথা জানিয়ে বলা হয়, সেটা দিয়ে মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল।
ভোলা বলেন, ‘আমার কাছে কোনো অস্ত্র পায়নি। কোনো একটা লেবারের কাছে দেখাইছে। তারে বানাইছে আমার লেবার, ওরা শিখাই দিছে। তাকে ডিবির পাহাড়ে (লালদীঘি এলাকায় ডিবি কার্য়ালয়) এনে জিম্মি করে বলছে, অস্ত্র ভোলা দিছে বলবি, না হলে ক্রসফায়ারে দেবো।’
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানা ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন।
২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সাতজনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ১০ অক্টোবর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। চলতি বছরের ১৩ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ৯ এপ্রিল থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্য দেন।
অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু ও শাহজাহান মিয়া।
আসামিদের মধ্যে শুধু মুসা পলাতক আছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে। মামলাটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে।
সারাবাংলা/আইসি/টিআর