ঢাকায় উত্তরের চেয়ে দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি
৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:২৭ | আপডেট: ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৩:০০
ঢাকা: রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৫৬টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোর তুলনায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত ‘মনসুন এডিস সার্ভে-২০২৪’-এর ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মেয়াদ অনেক বেশি। অন্যান্য বছরে জুন-অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকলেও এ বছর ডিসেম্বর মাসেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিদ্যমান।
আইইডিসিআর পরিচালক আরও বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার লক্ষ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৯টি ও ঢাকা উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪০টি ওয়ার্ডসহ দুটি সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
জরিপের ফলাফল তুলে ধরে ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, জরিপে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চেয়ে আনুপাতিক হারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বেশি পাওয়া গেছে। ঢাকার সব হাসপাতালেই ডেঙ্গু রোগীর চাপ রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বারডেম হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল, সেন্ট্রাল মুগদা হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল উল্লেখযোগ্য। ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলার অনেক ডেঙ্গু রোগীও ঢাকায় চিকিৎসা নেন। এ কারণে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, সচেতনতাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল মন্ত্র। আমরা সবাই জানি, কোথায় মশা উৎপত্তি হয়, কীভাবে ছড়ায়, কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু আমরা কেউ নিয়ম মানতে, সচেতন হতে রাজি নই। এটাই ডেঙ্গু বিস্তারে মূল সমস্যা। আমাদের অসচেতনতাই ডেঙ্গু মশা বিস্তারের মূল কারণ।
তিনি আরও বলেন, আমরা একে অন্যকে দোষারোপ করি। কিন্তু মশার কামড় সবাই ভোগ করি। কাউকে দোষারোপ না করে ডেঙ্গু মশা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যার যার অবস্থান ও কর্মস্থল থেকে আমরা সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করি, তবেই এ মহামারি থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি।
ডেঙ্গুর উৎপত্তি ও নিরাময়ের বিষয়ে সভায় অবহিত করা হয়, সম্মিলিতভাবে গৃহায়ন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুই সিটি করপোরেশনকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলতে পারে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নির্মাণাধীন বাড়িতে জলাবদ্ধতার বিষয়ে সতর্কতার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে। দুই সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ও লার্ভা নিধনের জন্য পদক্ষেপ নেবে। জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে এ মশার বংশ বিস্তার প্রতিরোধ এবং মশার কামড় হতে নিরাপদ থাকার জন্য।
এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। স্বীকৃত এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করা হয়।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, রাজধানীর দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৬টি ওয়ার্ডেই ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো— ৩৮, ৯, ৩০, ৭, ৮, ১৮, ২৫, ২৮, ৩৬, ৩৭, ১ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো— ৪৭, ৫৩, ৬১, ৫০, ২, ১৬, ২৬ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড। এর বাইরে বাকি ওয়ার্ডগুলোর বিষয়ে স্পষ্ট করেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর।
জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে এডিসের ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৩৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পরের অবস্থানে রয়েছে ৯ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড। এগুলোতে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ শতাংশ এবং ৮, ১৮, ২৫, ২৮, ৩৬ ও ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া ১ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ২৪ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ঢাকার সবচেয়ে বেশি— ৭০ শতাংশ। পরের অবস্থানে থাকা ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ৬৬ দশমকি ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া ৬১ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৬ দশমকি ৬৭ শতাংশ এবং ১৬, ২৬ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৩ দশমমিক ৩৩ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে।
জরিপের ফলাফলে আরও দেখা গেছে, দুই সিটিতে জরিপ করা তিন হাজার ১৩৪টি বাড়ির মধ্যে ৫৪৬টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা ও পিউপা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে বহুতল ভবন ৫১ দশমিক ২৮ শতাংশ, স্বতন্ত্র বাড়ি ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবন ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, সেমিপাকা বাড়ি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ ও খালি জায়গা ৪ দশমিক ২ শতাংশ।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে মশার ঘনত্ব পরিমাপক সূচক ব্রুটো ইনডেক্স ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ ও হাউজ ইনডেক্স ১৬ দশমিক ১ শতাংশ। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটিতে মশার ঘনত্ব পরিমাপক সূচক ব্রুটো ইনডেক্স ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও হাউজ ইনডেক্স ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর