লতিফের ‘ডানহাত’ পরিচয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠেন যুবলীগের দেবু
৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:৪৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের চট্টগ্রামের একসময়ের আলোচিত নেতা ছিলেন দেবাশীষ পাল দেবু। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রামের বন্দর আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। একসময় তিনি লতিফের ‘ডানহাত’ হিসেবে পরিচিতি পান। লতিফের আশীর্বাদে সিইপিজেডে ঝুট এবং বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ বছরে ছাত্রনেতা থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন দেবু।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে অস্ত্রবাজির অভিযোগে একাধিক মামলার আসামি দেবু গত চার মাস ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর মাইলের মাথা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে বন্দর থানা পুলিশ।
জানা গেছে, নগরীর বন্দর এলাকার বাসিন্দা দেবাশীষ পাল দেবু নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) সভাপতি ছিলেন। ওই কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন তিনি। এরপর সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এছাড়া, ২০০১ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্যও ছিলেন।
ছাত্র রাজনীতিতে থাকার সময় দেবু চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনের অনুসারী ছিলেন। এ হিসেবে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। মহিউদ্দিন যখন চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন, দেবুকে বন্দর ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করেছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, বন্দর ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে দেবু গোপনে আন্দোলনের বিরোধী মহলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। মূলত তখন থেকেই বন্দরকেন্দ্রিক বিভিন্ন আয়-উপার্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর মহিউদ্দিনের ‘গুডবুক’ থেকে খারিজ হন দেবু।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের একাংশ মহিউদ্দিনের বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন দেবুও।
সূত্র মতে, দেবাশীষ পাল দেবু তার ‘রাজনৈতিক গুরু’ খোরশেদ আলম সুজনকেও মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। কিন্তু সুজন সেই অবস্থান না নেওয়ায় তার সঙ্গেও দেবুর সম্পর্কের অবনতি হয়। এরপর দেবু ভেড়েন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রয়াত ডা. আফছারুল আমিনের সঙ্গে, যিনি আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে কিছুদিন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পাশাপাশি বন্দর আসনের সেসময়কার সংসদ সদস্য বর্তমানে কারাবন্দি এম এ লতিফের সঙ্গে দেবুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় পর্যন্ত লতিফ-দেবুর একসঙ্গে চলা অব্যাহত ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরকেন্দ্রিক এক ব্যবসায়ী সারাবাংলাকে বলেন, ‘লতিফের মাধ্যমেই মূলত বন্দর ও সিইপিজেডে দেবাশীষ পাল দেবুর উত্থান হয়। বন্দরে আসা কনটেইনারবাহী জাহাজ থেকে যে পরিত্যক্ত কাঠ বের হয়, সেগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করতো লতিফের অনুসারীদের কয়েকটি সিন্ডিকেট। এ ব্যবসায় দেবুর সংশ্লিষ্টতা ছিল। এছাড়া বন্দরে কেনাকাটা, কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কসহ আরও বিভিন্ন ব্যবসায় দেবুর অংশগ্রহণ ছিল।’
‘তবে দেবুর আয়-উপার্জনের বড় অংশ এসেছে সিইপিজেডে ঝুট ব্যবসা করে। পাশাপাশি সিইপিজেডে ক্যান্টিন পরিচালনা করতেন তিনি। ১৫ বছর ধরে বন্দর ও সিইপিজেডে একচ্ছত্র ব্যবসা করে গেছে দেবু ও তার লোকজন। এভাবে সে না হলেও অন্তত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন,’– বলেন ওই ব্যবসায়ী।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত দেবাশীষ পাল দেবুকে নগরীতে দামি গাড়িতে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। সূত্র জানায়, নগরীর কে সি দে রোডসহ আরও বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে তার। সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও ইপিজেড থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির আহমেদ খোকনের সঙ্গে মিলে ‘বায়েজিদ এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন। এছাড়া, পোশাক, আবাসনসহ আরও বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন তিনি।
তবে গত চার-পাঁচ বছর ধরে দেবু দান-খয়রাতে মনযোগ দেন। করোনার সময় ব্যাপক হারে ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, সবজি, রান্না করা খাবার বিতরণ করেন। এছাড়া, বন্দর আসনের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও অর্থ বিতরণ করতে দেখা যায় তাকে।
২০২২ সাল দেড় বছর ধরে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য ব্যাপক তোড়জোড় করতে দেখা যায় দেবাশীষ পাল দেবুকে। পদ পেতে মরিয়া হয়ে বিরাট অংকের টাকা খরচ করেন বলে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ-যুবলীগের মধ্যে তখন আলোচনা ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকে সহ-সভাপতি করা হয়। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বন্দর আসন থেকে মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমও কেনেন দেবাশীষ পাল দেবু। তবে ওই আসনে চতুর্থবারের মতো মনোনয়ন পান এম এ লতিফ, যিনি এখন কারাগারে আছেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম
এম এ লতিফ খোরশেদ আলম সুজন ঝুট ব্যবসা দেবাশীষ পাল দেবু যুবলীগ সিইপিজেড