Thursday 12 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আ.লীগের আদর্শ প্রচারের প্রতিশ্রুতিতে অনুমোদন, চলছে টিভি চ্যানেল!

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০১:১৯ | আপডেট: ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১১:৫৯

বৃহস্পতিবার টিআইবির অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। ছবি: সারাবাংলা

ঢাকা: কেবল আওয়ামী লীগ কর্মী পরিচয়ে দলটির আদর্শ ও সরকারের উন্নয়নের তৎপরতা প্রচারের জন্য টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিগত সরকারের আমলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে, যেটি এখনো সম্প্রচারে আছে।

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ‘নতুন বাংলাদেশ: কেমন গণমাধ্যম চাই?’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ এ কথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

কামাল আহমেদ বলেন, বিগত সরকার ৪৬টি টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন দিয়েছে। এমন আবেদনপত্রও আমি দেখেছি, যেখানে লেখা ছিল— ‘আমি আওয়ামী লীগের কর্মী। আওয়ামী লীগ করেছি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আদর্শ ও উন্নয়নের তৎপরতা প্রচারের জন্য টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমার চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হোক।’

তিনি বলেন, এ ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা সেই আবেদনে ছিল না। এই বক্তব্য ছাড়া সেই আবেদনপত্রে কোনো ‘মিশন স্টেটমেন্ট’ ছিল না। কিন্তু তিনি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন পেয়েছেন, যার সম্প্রচার এখনো চলছে। এই টেলিভিশন কেন্দ্রকে কি গণমাধ্যম বলা যাবে?— প্রশ্ন রাখেন কামাল আহমেদ।

তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বড় ধরনের একটি কৌশল ছিল— যারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করবে তাদের তথ্য যেন হারিয়ে যায় অন্য আরও অজস্র প্রচার মাধ্যমের প্রচারণায়। সে কারণে তারা সংবাদ প্রকাশ থেকে শুরু করে আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও বাজারের আকার বা কোনো কিছুই বিবেচনায় না নিয়ে যথেচ্ছভাবে টেলিভিশন কেন্দ্র খোলার এবং সংবাদপত্র প্রকাশ করার অনুমোদন দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যমের জন্য ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, জনস্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না বা জনস্বার্থের পক্ষে কাজ হচ্ছে কি না, সেই পরীক্ষা যদি আমরা না রাখি তাহলে টেলিভিশন চ্যানেল বা সংবাদপত্র যাই হোক না কেন, সেটাকে কি আমরা গণমাধ্যম বলব? এ প্রশ্নের উত্তর আসা জরুরি, আলোচনা হওয়া জরুরি। নইলে অনেক মাধ্যম তৈরি হবে, যা কপি-পেস্ট করেই চলবে।

কেবল সরকারি বিজ্ঞাপন, স্মরণিকা বা ক্রোড়পত্র পাওয়ার জন্য অনেক সংবাদপত্র নামমাত্র কপি ছাপা হয় উল্লেখ করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, এমন অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, যেগুলো আসলে খুব বেশি হলে ১০০ থেকে ২০০ বা ৩০০ কপির বেশি ছাপা হয় না। দেখা যায়, একই প্রেসে সামান্য কিছু পরিবর্তন করেই এগুলো ছাপা হচ্ছে। তাদের কোনো খরচ নেই। কোনো সাংবাদিক নেই, স্টাফ নেই। দেখা যাবে, তার পরিবারের সদস্যরাই সেখানে নানা পদে বসে আছেন। এ ধরণের পত্রিকাগুলো গণমাধ্যম? অথচ এই সরকারি বিজ্ঞাপন বা স্মরণিকার বরাদ্দ কিন্তু পাওয়ার কথা ছিল মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর।

যেসব সংবাদপত্র ছাপা হচ্ছে সেগুলোও নিয়ম-নীতি মেনে ছাপা হচ্ছে না উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, ঢাকা শহর থেকে ৫৪২টি বা ৫৪৬টি পত্রিকা বের হয় ডিক্লারেশন দিয়ে। বর্তমান আইন অনুযায়ী, সম্পাদক হওয়ার জন্য ন্যূনতম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই যে এত পত্রিকা বের হচ্ছে, এগুলোর কতজন সম্পাদকের এই ন্যূনতম অভিজ্ঞতা আছে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অধিকাংশেরই তা নেই। এইগুলোকে পত্রিকা বলা যাবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার রাজনৈতিক প্রভাবে পরিচালিত হতো। সেগুলো কি জনকল্যাণমুখী গণমাধ্যম ছিল? সেখানে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশনা ছিল যে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, এরপর দলের সেক্রেটারি, এরপর তথ্যমন্ত্রী আর এরপর অন্যান্য মন্ত্রী বা নেতাদের খবর দেখাতে হবে। কোনো সম্পাদকীয় নীতিমালা সেখানে ছিল না।

সরকারি দুই গণমাধ্যমে জবাদিহিতা ছিল না উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, একটি টেলিভিশন চ্যানেলের বাজেট কত? রেডিওতে এ বছরের বাজেট ১৩০ কোটি টাকা। এই টাকাগুলো কোথায় খরচ করা হয়েছে? এখানে ছিল না কোনো জবাবদিহিতা।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বড় বাজেট প্রয়োজন উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, আল-জাজিরার যে দুটি প্রতিবেদন আলোচিত ছিল, সেখানে তারা মাসের পর মাস কাজ করেছে। প্রথম প্রতিবেদনে তারা প্রায় বছরখানেক কাজ করেছে। এর জন্য একটি ইউনিট তারা প্রতিষ্ঠা করে আলাদাভাবে। তাদের আর অন্য কোনো কাজ ছিল না। শুধু অনুসন্ধানী সংবাদের কাজটাই করেছে। আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো সময় দিয়ে সেই কাজটা করবে? যদি করে, তবে আমাদের দেশেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আরও সমৃদ্ধ হবে।

টিআইবির আলোচনায় আরও অংশ নেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, ডেইলি নিউ এজের সম্পাদক নুরূল কবীর, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ।

এর আগে প্রথম অধিবেশন সঞ্চালনা করেন টিআইবি পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও প্রশিক্ষক মোহা. বদরুদ্দোজা, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও প্রশিক্ষক কুররাতুল-আইন-তাহমিনা, গ্রামের কাগজ (যশোর) সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, ইউএসএ (ওয়াশিংটন) প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা।

এ দিন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার-২০২৪’ বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এবার জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জায়মা ইসলাম। ডেইলি স্টারের ‘আলমস আলাদিনস ল্যাম্প’ শিরোনামে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য তিনি এ পুরস্কার পেয়েছেন।

টেলিভিশন (প্রামাণ্য অনুষ্ঠান) বিভাগে বিজয়ী হয়েছে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘তালাশ’। ‘গরিবের চাল-আটা খায় ডিলার ও কর্মকর্তায়’ শিরোনামে প্রচারিত প্রামাণ্য অনুষ্ঠানের জন্য তালাশ টিম এ বছর পুরস্কারটি পায়।

আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছেন চট্টগ্রামের একুশে পত্রিকা ডটকমের প্রধান প্রতিবেদক শরীফুল ইসলাম। ‘চিকিৎসাসেবকদের লোভের বলি রোগী’ শিরোনামে প্রকাশিত তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য তিনি এ পুরস্কার পেয়েছেন।

বিজয়ী প্রত্যেক সাংবাদিক ও তালাশ টিমকে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট ও দেড় লাখ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়। টিআইবি জানায়, ২০২৪ সালে টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কারের জন্য ৫৯টি প্রতিবেদন জমা হয়। এর মধ্যে আঞ্চলিক সংবাদপত্র বিভাগে সাতটি, জাতীয় সংবাদপত্র বিভাগে ৩৪টি, টেলিভিশন বিভাগে আটটি এবং প্রামাণ্য অনুষ্ঠান বিভাগে ১০টি প্রতিবেদন জমা পড়ে।

এর আগে অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সাংবাদিকদের আগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানান টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের অনুসন্ধান করা প্রতিবেদনগুলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে। গত ২৬ বছরে এক হাজার ৪৪০টি প্রতিবেদন জমা হয়েছে টিআইবিতে। এর পুরস্কার পেয়েছেন ৯০টি প্রতিবেদন।

এ সময় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করতে টিআইবি নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান ড. ইফতেখারুজ্জামান।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা গণমাধ্যম টিআইবি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর