Wednesday 11 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারতের ৪৯ গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ১৩টি ভুয়া খবর: রিউমার স্ক্যানার

সারাবাংলা ডেস্ক
৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৩৩ | আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৫১

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর। ছবি: রিউমার স্ক্যানার

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর ছাপা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ ও তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার। এসব ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় রয়েছে ভারতের ৪৯টি গণমাধ্যম।

রিউমার স্ক্যানারের তথ্য বলছে, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি ভুয়া খবর ছাপিয়েছে কলকাতাভিত্তিক রিপাবলিক বাংলা। এ ছাড়া তিনটি করে ভুয়া প্রতিবেদন ছাপিয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট। আর রিপাবলিক, এবিপি আনন্দ, ইন্ডিয়া টুডে ও আজতক অন্তত দুটি করে গুজব প্রচার করেছে।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার নিজেদের ওয়েবসাইটে ‘ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশ। তাদের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর গ্রেফতারের পর নানা ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ালে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে খবর প্রচার বেড়ে যায়।

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যেসব গুজব ছড়িয়েছে তার মধ্যে রয়েছে— শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি, মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ পুত্রের সন্ধানে মানববন্ধন করার ভিডিওকে হিন্দু ব্যক্তির দাবিতে প্রচার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার ভুয়া খবর, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ভিত্তিহীন দাবি, ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার ভুয়া দাবি, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবী হিসেবে প্রচার, বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়া গুজব, বাংলাদেশে মুসলিমদের হামলায় হিন্দু মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের দাবিতে ভারতের প্রতিমা বিসর্জনের ভিডিও প্রচার, শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলার মিথ্যা তথ্য, চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীর ওপর হামলার ভুয়া দাবি এবং বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হতে পারে জানিয়ে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ সতর্কতা জারির মতো ভুয়া খবরও ছাপা হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যমে।

৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে জনগণের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন এবং ওই চিঠিতে তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়ে।

পরে জানা যায়, শেখ হাসিনা এমন কোনো চিঠি দেননি। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই চিঠিটি প্রথমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে ভারতের আগরতলাভিত্তিক দৈনিক ‘ত্রিপুরা ভবিষ্যত’ পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে তারিখসহ প্রকাশিত হয়। ওই পত্রিকার স্ক্রিনশটটিই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার হতে থাকে এবং পরে ভারত ও বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমেও এটি প্রচারিত হয়।

৫ আগস্টের পর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয়, একজন হিন্দু ব্যক্তি তার নিখোঁজ পুত্রের সন্ধান দাবিতে মানববন্ধন করছেন। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে মুসলিম, তার নাম বাবুল হাওলাদার। ২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া ছেলের সন্ধানে মানববন্ধন করেছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছেন। এ দাবির সঙ্গে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তির ছবিও প্রকাশিত হয়। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবিটি ড. ইউনূসের নয়। ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের কিংবা বাংলাদেশেরও কোনো ছবি নয়। প্রকৃতপক্ষে ড. ইউনূস সুস্থ রয়েছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে বেশ কিছু নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে ভারতীয় গণমাধ্যম। রিউমার স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে এ দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হন। ট্রাম্পের বিজয়ের পর, ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এ দাবি মিথ্যা। পালানোর প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত বিমানের ছবিটি ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময়ের।

স্বাধীনতার পর গত ১৩ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সরাসরি পাকিস্তানের করাচি থেকে কনটেইনার বহনকারী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। এ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের ‘সোয়াত’ নামের যে সামরিক জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এসেছিল, সেই জাহাজ আবারও চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। আরও দাবি করা হয়, ওই জাহাজে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে অস্ত্র আনা হচ্ছে। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এসব দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। জাহাজটির নাম ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’, এটি একটি বাণিজ্যিক জাহাজ এবং এর মাধ্যমে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আনা হয়েছে।

গত ২৫ নভেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করেন। এরপর আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা ছড়ালে চিন্ময়কে প্রিজন ভ্যানে তুলে কারাগারে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। সংলগ্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে চিন্ময়ের অনুসারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় চট্টগ্রাম জেলা আদালতের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হন। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, সাইফুল ইসলাম চিন্ময়ের আইনজীবী হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এ দাবি সঠিক নয়। চিন্ময়ের আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা, সাইফুল ইসলাম নন।

ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে চ্যানেলগুলো এখনো সচল থাকতে দেখা যায়। একই সঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বিষয়টি গুজব বলে রিউমার স্ক্যানারকে নিশ্চিত করে।

ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় চিকেন নেকের কাছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি নির্মাণ করবে। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবি পুরোপুরি মিথ্যা। লালমনিরহাটের বিমানবন্দর দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বন্ধ রয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এর কার্যক্রম পুনরায় চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি বাংলাদেশে মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু মন্দিরে হামলা করে প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগের একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এ দাবি ভারতের কিছু গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওভারতের ৪৯ গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ১৩টি ভুয়া খবর: রিউমার স্ক্যানারটি বাংলাদেশে নয়, বরং ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ সুলতানপুর গ্রামে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য। ভিডিওটি বাংলাদেশের হিন্দু মন্দিরে হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢাকা-আগরতলা-ঢাকা রুটে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে বাংলাদেশি ট্রাকের সংঘর্ষ ঘটানোর দাবিতে ভারতের কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। আরও দাবি করা হয়, শ্যামলী পরিবহনের বাসে থাকা ভারতীয় যাত্রীদের স্থানীয়রা প্রাণনাশের হুমকি দেয় এবং ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এ দাবিগুলোর কোনো সত্যতা নেই। ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, দুর্ঘটনাটি মূলত ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটেছিল।

চিন্ময় দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের চিকিৎসাধীন এক ব্যক্তির ছবি নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়। দাবি করা হয়, ওই ব্যক্তি রমেন রায়, যিনি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী। আরও বলা হয়, মুসলিমরা তার বাড়ি ভাঙচুর করে এবং হামলা চালিয়ে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করেছে। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রমেন রায় চিন্ময় দাসের আইনজীবী নন এবং তার মামলার সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত ২৫ নভেম্বর শাহবাগে চিন্ময় দাসের গ্রেফতারের প্রতিবাদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কর্মসূচিতে দুর্বৃত্তদের হামলায় রমেন রায় আহত হন। তবে তার বাড়ি ভাঙচুরের খবর বা কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশে যেকোনো সময় জঙ্গি হামলা হতে পারে জানিয়ে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ সতর্কতা দিয়েছে দাবিতে একটি তথ্য ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম প্রচারিত হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যের ভ্রমণ সতর্কতা কেবল বাংলাদেশে নয় বরং ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, স্পেন, শ্রীলংকা, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অনেক দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সারাবাংলা/টিআর

গুজব ভারতীয় গণমাধ্যম ভুয়া খবর রিউমার স্ক্যানার

বিজ্ঞাপন

আসিফ আলতাফের ‘ব্যাকুল হৃদয়’
১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:৪০

আরো

সম্পর্কিত খবর