জ্বালানিতে বছরে ৫২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি, মাথাপিছু ৩ হাজার : জ্বালানি উপদেষ্টা
৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:২১ | আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:০০
ঢাকা : বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, জ্বালানি খাতে সরকারকে বছরে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে এবং মাথাপিছু ভর্তুকির এ হার প্রায় ৩ হাজার টাকা। গ্রাহকরা প্রতি ইউনিটের বিদ্যুতের গড় মূল্য ৮ টাকা ৫৫ পয়সা প্রদান করলেও সরকার কিনে ১২ থেকে ২৫ টাকায়। অন্যদিকে এলএনজি আমদানিতে প্রতি ইউনিট ৭০ টাকা খরচ পড়লেও শিল্প খাতে ৩০ টাকা হারে সরবরাহ করা হচ্ছে।
শনিবার (০৭ ডিসেম্বর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘জ্বালানির সহনীয় মূল্য ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ খাতে প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি এবং গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের এককচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে সরকারকে অধিক মূল্যে জ্বালানি ক্রয় করতে হচ্ছে। তবে এখন থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ছাড়াও কোন দরপত্র আহ্বান করা হবে না।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানির কারণে পূর্বের চেয়ে ৩৫ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্য পাওয়া গেছে, এর ফলে সাশ্রয় হবে ৩৭০ কোটি টাকা। ভোলায় প্রায় ৭০ সিএমএফএফটি গ্যাস মজুদ রয়েছে, এটি উত্তোলনেও উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, আমাদের ৪ হাজার এমএমসিএফটি গ্যাসের প্রয়োজন, এর বিপরীতে আমাদের রয়েছে ৩ হাজারের কম। এমতাবস্থায় ঘাটতি মেটাতে নিজের গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
বিদ্যুৎ খাতে আইপিপি’র পরিবর্তে ‘মার্চেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবস্থা’ চালু করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে ৪০টি সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে এবং এ ধরনের প্রকল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান সরকার থেকে করা হবে। সরকারী কিছু সংস্থা যেমন- বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেল, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক বিভাগের অনেক জমি আছে, যেটা ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেখানে এধরনের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হবে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ১৫ বছরের জন্য কর অব্যাহিতর সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ খাতে অর্থায়নের জন্য বন্ধকী ঋণের পরিবর্ততে সম্পদ ভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থা প্রচলনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, এর মাধ্যমে ঋণ প্রক্রিয়া আরো নিরাপদ হবে।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, বিগত ৫০ বছরে আমাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর থেকে শিল্প ও সেবা খাত নির্ভর হয়ে উঠেছে, তাই এখন জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ও সহনীয় মূল্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গত দুই দশকে আমাদের জ্বালানির ব্যবহার প্রায় চারগুন বেড়ে ৪৫ মিলিয়ন টন অফ অয়েল ইকুইভ্যালেন্ট (টিওই)-এ পৌঁছে গেছে। শিল্পখাতে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানির কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি জ্বালানি ব্যবহারে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশীয় মজুদকৃত কয়লা উত্তোলনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও কয়লা উত্তোলন কার্যক্রম বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে সৌর বিদ্যুতের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্তেও ভূমি বরাদ্দ ব্যবস্থাপনায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জমির অপ্রতুলতার কারণে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি। এ বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনা করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশ পুরোনো এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা উল্লেখজনক হারে হ্রাস পাবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পারমানবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন বাড়ানো দরকার, তেমনি জ্বালানি আমদানিতে বিদ্যমান সরকারি ক্রয় নীতিমালা সংশোধন করে মূল্য স্থিতিশীল রক্ষার কৌশলও নিতে হবে। এছাড়া এনার্জি স্টোরেজ টেকনোলোজির ব্যবহার বাড়িয়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ ব্যবহারিক হবে না, বরং এক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ বছরের কর্মপরিকল্পনা অধিক কার্যকর হবে। বাংলাদেশকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে, তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশকে জ্বালানি স্বনির্ভর করা ও জ্বালানির মূল্য হ্রাসে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিতে হবে।
তিনি বলেন, নবায়ানযোগ্য জ্বালানি শক্তি উৎপাদনের জন্য আমাদের গৃহস্থালির ছাদ ব্যবহার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে ২০২০-২১ অর্থবছরের পর টাকা অবমূল্যায়ন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি আমদানি এবং আন্তর্জাতিক জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিস্টেমের ক্ষতির কারণে কমপক্ষে ৫ শতাংশ গ্যাস নষ্ট হচ্ছে, যা ১৩০ এমএমসিএফডি-এর সমতুল্য। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে কয়লা বাংলাদেশের ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উত্তোলনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এলএনজি আমদানির জন্য দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি বা হেজিং ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য এলএনজি সঞ্চয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সারাবাংলা/আরএস