দুদককে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ার আহ্বান
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:২৪ | আপডেট: ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৫
ঢাকা: ‘নতুন বাংলাদেশে’র মূল চেতনাকে সমুন্নত রাখতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জবাবদিহি নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে দুদককে দলীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
রোববার (৮ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২৪ উপলক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।
মানববন্ধনে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা এমন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই যেখানে নেতৃত্ব পর্যায় থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ থাকবে, বিশেষ করে কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে যেন নিয়োগ দেওয়া না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তারপর সচিব ও মহাপরিচালক পর্যায়ে আমলাতান্ত্রিক আনুগত্যকে ধ্বংস করতে হবে। এ দুটি বিষয় সম্পন্ন করতে না পারলে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন কখনও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। আর সে পরিবেশ তৈরির করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। আমরা আশা করব সরকার সে বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
মানববন্ধনে আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস ২০২৪ এর এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘নতুন বাংলাদেশ:দুর্জয় তারুণ্য দুর্নীতি রুখবেই’ শিরোনামে ধারণাপত্র পাঠ করেন টিআইবির আউটরিচ ও কমিউনিশন বিভাগের উপ সমন্বয়ক (ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর) জাফর সাদিক। মানবন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কয়েকশ মানুষ অংশগ্রহণ করে।
মানববন্ধন থেকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২৪ উপলক্ষে দুর্নীতি প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণে টিআইবি সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য ১৪ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-
১. মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রকৃত চেতনার আলোকে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে এদেশের সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চয়তাসহ একটি বৈষম্যমুক্ত, এ অসাম্প্রদায়িক, জবাবদিহিমূলক, সুশাসিত, দুর্নীতিমুক্ত, মানবাধিকার-ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে উদ্যোগী হতে হবে।
২. ‘নতুন বাংলাদেশে’র মূল চেতনাকে সমুন্নত রাখতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জবাবদিহি নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ-প্রক্রিয়াসহ সংস্থাটির কার্যক্রম দলীয় প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণে দুদকের ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনের (সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮: মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২; আয়কর আইন, ২০২৩) এমন সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ সংশোধন করতে হবে। সর্বোপরি দুদক সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনসমূহ যাতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ এবং এ রূপ সংস্থার গঠন, নিবন্ধন, ব্যবস্থাপনা-প্রক্রিয়া সহজতর করাসহ উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রশাসনিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
৪. বিচার বিভাগের নিয়োগ, পদায়ন, বদলিসহ বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে অবিলম্বে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন করতে হবে।
৫. দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নের পাশাপাশি একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী তৈরিতে এর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাঠামো পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি বাহিনীটির কাঙ্ক্ষিত পেশাগত উৎকর্ষ এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি-কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।
৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূণ্য সহনশীলতার ফাঁকাবুলির সংস্কৃতি পরিহার করে সকল প্রকার বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিচারহীনতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৭. ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাংকিং খাত-সংশ্লিষ্ট নিরপেক্ষ, স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত, স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম এমন দক্ষ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ‘স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন’ করতে হবে।
৮. সংশ্লিষ্ট আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যে সকল দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সে সকল দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আইনি সহায়তা জোরদারসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৯. কর ফাঁকি ও অর্থপাচার রোধে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সকল প্রকার লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান- প্রদান সহায়ক ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’ (সিআরএস) অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০. সরকারি ক্রয়-ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল দরপত্র ই-জিপি প্রক্রিয়ায় সম্পাদন এবং উন্মুক্ত ও সীমিত দরপত্র-পদ্ধতিতে মূল্যসীমার বিধান বাতিল করতে হবে।
১১. সরকারি কার্যে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থতা, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।
১২. অবাধ তথ্যপ্রবাহের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি ভিন্নমত, বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থী নজরদারিভিত্তিক ভীতিকর পরিবেশ, তথা সকল জনগণের জন্য নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টির সংস্কৃতি যেন আবার ফিরে না আসে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৩. রাজনৈতিক দলের সকল প্রকার গৃহীত অনুদান, আয়-ব্যয়, বিশেষ কার্যক্রমভিত্তিক সংগৃহীত অর্থ ও ব্যয়, প্রচারণাসহ নির্বাচনী ব্যয়, মনোনয়ন-কেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেনকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করতে হবে। এবং
১৪. সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এনজে
আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত ড. ইফতেখারুজ্জামান দুর্নীতি দমন কমিশন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত