Monday 09 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হারিয়ে যাচ্ছে বেগম রোকেয়ার স্মৃতি, উদ্যোগ নেই সংরক্ষণের

রাব্বি হাসান সবুজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৪৪ | আপডেট: ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:০১

রংপুর: আজ ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। নারীর দুঃখ-দুর্দশা ও সমান অধিকারের দাবিতে লড়াই করা বেগম রোকেয়াকে শুধুমাত্র এই দিনটাতেই স্মরণ করা হয়। অনেকটা অবহেলাতেই কেটে যায় গুরুত্বপূর্ণ এই দিনটি। দিবসটি আসলেই কয়েকদিন আগে থেকে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ও বসতভিটার খোঁজ করতে থাকেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। স্মৃতিকেন্দ্রটির ধোয়ামোছা, রঙ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। আলোচনা সভা, সেমিনারে বড় বড় বক্তৃতার পর আর খোঁজ থাকে না। বেগম রোকেয়া দর্শনকে নতুন প্রজন্মকে জানাতে কোনো সরকারের আমলেই নেওয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। এতে ক্ষোভ বাড়ছে রোকেয়া অনুরাগীদের।

বিজ্ঞাপন

বেগম রোকেয়ার জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে তার জন্মভূমি রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে প্রায় তিন দশক আগে স্মৃতিকেন্দ্র গড়ে তোলা হলেও অনেকটা অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র মিলে বেশ সমৃদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রটি কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সেটি আঁধারে ঢাকা। এটি খোলার উদ্যোগ নেই কারও। স্মৃতিকেন্দ্রটি একটি ভবনেই শুধু সীমাবদ্ধ। পাশাপাশি দখলদারদের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে যেতে বসেছে বেগম রোকেয়ার বসতভিটাও। চার পাশে দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই কঙ্কালসারশূণ্য। এসব স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই জেলা প্রশাসন ও দায়িত্বশীলদের। তাই অতিদ্রুতই এসব সার্বক্ষণিক দেখভালের দাবি রোকেয়া স্বজন, স্থানীয় ও অনুরাগীদের।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে রোকেয়া স্মৃতিচিহ্ন ঘুরে দেখা গেছে, রোকেয়ার বসতভিটা একেবারেই অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। সেটিই যে রোকেয়ার বাসস্থান ছিল এক সময় সেটা বোঝাও মুশকিল। শুধুমাত্র পড়ে আছে ধ্বংসাবেশ। সংরক্ষণের অভাবে দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ ক্রমেই মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এসব দেখে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বেগম রোকেয়ার অনুরাগীরা ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেন।

রংপুরের চতরা কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হারুন অর রশীদ চৌধুরী বলেন, নারীর দুঃখ-দুর্দশা ও সমান অধিকারের দাবিতে লড়াই করে গেছে আমৃত্যু। বেগম রোকেয়াকে নতুন প্রজন্ম যে জানবে সেই সুযোগ খুবই কম। তার স্মৃতিচিহ্ন দেখে অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যান। খুব দ্রুতই তথ্যসমৃদ্ধ একটি স্মৃতিচিহ্ন বাস্তবায়ন করা জরুরি।

এদিকে, রোকেয়া স্মৃতিকেন্দের ভেতরে মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র সব থাকলেও অজানা কারণে দরজায় ঝুলছে তালা। সংস্কারের অভাবে ভবনের পলেস্তারা খসে পড়ছে। দৃষ্টিনন্দন মিলনায়তনটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। বেশিরভাগ কক্ষের জানালার কাচ ভাঙা। সংগ্রহশালার ধূলিমলিন কাচের আলমারিগুলোতে নেই কোনও স্মারক। সব কক্ষের দেয়ালে পড়ে আছে শ্যাওলা। ভেতরের জিনিসপত্র এবং আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাকি জিনিসপত্র। নেই সংস্কারের উদ্যোগ। কার্যত ছয় বছর ধরে স্মৃতিকেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

রোকেয়া অনুরাগীরা জানান, বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে জন্মভূমিতেই, এখানেই তাকে ধারণ ও চর্চা করা হয় । কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনার কার্যত কোন উদ্যোগ নেই। পরিবারের পক্ষ থেকে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে পায়রাবন্দের রোকেয়া মেলায় তার দেহাবশেষ এনে নিজ গ্রামে বাবার কবরের পাশে সমাহিত করার দাবি তুলেছিল পরিবার। তৎকালীন জেলা প্রশাসক বি এম এনামুল হক সেই দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে ২০১০ সালে তার পরিবার ও স্থানীয়দের বিভিন্ন দাবি সংবলিত একটি লিখিত আবেদন সরকারের সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন দফতরে পাঠান। এরপর দীর্ঘ সময়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

রোকেয়ার স্বজনদের অভিযোগ, ২০১০ সালে ডিসির আবেদনের পর প্রতি বছর আলোচনা হলেও দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনতে কাগজে-কলমে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে ক্ষুব্ধ হয়েছেন তার পরিবার স্বজন এবং রোকেয়া অনুরাগী।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বরে কলকাতায় মৃত্যু হলে বেগম রোকেয়াকে কলকাতা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী পানিহাটি গ্রামে দাফন করা হয়। তখন তাকে কলকাতায় দাফনে বাঁধা দিয়েছিল সেখানকার রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ। শেষ পর্যন্ত বেগম রোকেয়াকে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের বন্ধু ব্যারিস্টার আব্দুর রহমানের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সোদপুরের পানিহাটিতে তার কবরটি বহু বছর ছিল সবার অজানা। অনেকটা অবহেলিত অবস্থায়ই ছিল কবরটি।

স্থানীয় বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, রোকেয়ার স্মৃতিকেন্দ্র ও বসতভিটার মতো স্বজনরাও অনেকটা অবহেলিত। কেউ কোনো খোঁজ রাখে না। বছরের একটি মাত্র দিনই স্মৃতিকেন্দ্রটির ধোয়ামোছা, রঙ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। একদিন পরেই আর কারও কোনো খোঁজ থাকে না। বছরের বাকি দিন অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে স্মৃতিকেন্দ্র ও বসতভিটা। রোকেয়ার স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার কোনো পদক্ষেপ নেই।

স্মৃতিকেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক আবিদ করিম জানান, রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের সব কার্যক্রম বন্ধ। তবে চালু হওয়ার আশা করছি। স্মৃতিকেন্দ্র দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলা একাডেমিকে বলেছি, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বই দিতে। নারীদের প্রশিক্ষণ ও সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথাও বলেছি আমরা।

স্মৃতিকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০০১ সালের ১ জুলাই এটির উদ্বোধন করা হয়। রোকেয়ার বসতভিটার সোয়া তিন একর জমির ওপর নির্মিত কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয় তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রকল্প ছিল, যা বাংলা একাডেমি দ্বারা পরিচালিত হতো। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০০৪ সালের ৫ অক্টোবর স্মৃতিকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেলে তা একই বছর এটি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যায়। ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা অবস্থায় ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এটি বিকেএমইর সেলাই কারখানা হয়েছিল। এরপর এই স্মৃতিকেন্দ্র চালু থাকলেও কোনো কার্যকারিতা ছিল না। ২০১৭ সালের ২৯ মে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটিকে রাজস্ব খাতে নিয়ে বাংলা একাডেমির কাছে দেয়।

স্মৃতিকেন্দ্রের ভবনটির মধ্যে রয়েছে ৩০০ আসনের মিলনায়তন, ১০০ আসনের সেমিনার কক্ষ, ১০ হাজার বই ধারণক্ষমতার গ্রন্থাগার, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা, প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসকক্ষ। এ ছাড়াও দুটি অতিথি ভবন রয়েছে। তবে বর্তমানে একজন সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ও সহ-গ্রন্থাগারিক ছাড়া কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। গ্রন্থাগারে বই নেই। গবেষণাকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা খালি। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কয়েক বছর আগে সংগীত শিক্ষার দুটি হারমোনিয়ামসহ অন্যান্য সামগ্রী ছিল, সেগুলো এখন নেই।

বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও রোকেয়া গবেষক রফিকুল ইসলাম দুলাল ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‌কোনো সরকার বেগম রোকেয়ার স্মৃতিচিহ্নটুকু পর্যন্ত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। এজন্য রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ও তার বসতভিটা হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ৫ আগস্ট আমরা নতুন বাংলাদেশ পেলাম। তবে এখনও বৈষম্য দূর হয়নি। আশা করছি, বর্তমান সরকার রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র ও তার বসতভিটা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে।

বেগম রোকেয়াকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে উল্লেখ করে রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম রোকেয়ার গ্রাফিতিতে কালো রঙ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার নামে প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব ভালো লক্ষণ নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি, বেগম রোকেয়ার সমাধি কলকাতা থেকে সরিয়ে তার জন্মভূমিতে যেন স্থানান্তর করা হয়। সেটির বাস্তবায়ন চাই আমরা। সেইসঙ্গে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র আবারও চালু করার দাবি জানাই।’

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র চালুর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করছি, এসব সমস্যা সমাধান করা হবে দ্রুতই।

রংপুরে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি:

দিবসটি উপলক্ষ্যে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। রয়েছে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আলোচনা সভার। অনুষ্ঠানে ‘রোকেয়ার অবরোধবাসিনী সামাজিক নকশার সেকাল-একাল’ এই শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করা হবে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের সভাপতিত্ব করবেন। এদিন স্থানীয় মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা, আলোচনা সভা, প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে।

কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার পায়রাবন্দে বিকেল থেকে আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন, কবিতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনী, নাটিকা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে।

সমাপনী দিনে বিকেল থেকে রয়েছে আলোচনা সভা, বিতর্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ, পদক প্রদান ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এদিন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম এনডিসি।

সারাবাংলা/ইআ

বেগম রোকেয়া দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর