Tuesday 10 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস
‘আমি শুধু বাবার হাতটা ধরে হাঁটতে চাই’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৩২ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৩

ঢাকা: কেউ হারিয়েছে বাবা, কেউ ভাই; কেউ হারিছেন ছেলে, কেউ আবার স্বজন। তারা যেমন এসেছেন তেমনি এসেছেন কেউ হাতবিহীন, আবার কারও পা নেই, কারও পায়ে ব্যান্ডেজ, কেউ ক্র্যাচে ভর করে এসেছেন, কেউ আবার প্রিয়জনের কাঁধে ভর করে। এদের মধ্যে কেউ আছেন জুলাই-আগস্টের ছাত্র-আন্দোলনে গুলির শিকার, আবার কেউ আছেন দীর্ঘদিন গুমের শিকার। তাদের একটাই চাওয়া, গুম হওয়া স্বজনদের যেন ফিরে পায়। সেইসঙ্গে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত ও গণহত্যায় জড়িত দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাসহ এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে সমবেত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর ১টা থেকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বিগত ১৫ বছরে গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিরা শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবি তুলেছেন।

এদিন উপস্থিত হয়েছিলেন ২০১৬ সালে গুমের শিকার পারভেজ হোসেনের একমাত্র মেয়ে হৃদি। হৃদির বয়স ছিল তখন দুই বছর। আজ সে ১১ বছরের কিশোরী। হৃদি বলছিলেন, ‘আমার বাবার কী দোষ ছিল যে, তাকে গুম করা হলো। আজও ফিরে এলো না আমার বাবা। আমরাই বা কি দোষ করেছিলাম, যার কারণে এখনো বাবাকে ফেরত পাইনি। আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই।’ এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে হৃদি। তার কান্নায় উপস্থিত সকলের চোখ ছলছল করছিল। হৃদি বলে, ‘ফিরিয়ে দাও আমার বাবাকে। আমার বাবাকে ফেরত চাই। আমি শুধু বাবার হাতটা ধরতে চাই।’

জুলাই আন্দোলনে ডান পা হারিয়েছে ১৫ বছরের টগবগে কিশোর মো. তামিম। সারাবাংলাকে তামিম বলে, ‘৫ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে বিজয় মিছিলে বের হই। মিরপুর মডেল থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় থানা থেকে বের হয়ে কিছু পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে। তখন আমার পায়ে গুলি লাগে। তার আগে, ১৮ জুলাই মিরপুর-২ নম্বরে আমি ছড়রা গুলির শিকার হই।’

তিনি বলেন, ‘সবাই বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা ছিলেন। কিন্তু আমরা যারা আহত ছিলাম তাদের কেউ খোঁজ নিচ্ছিলেন না। প্রথমে মিরপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি হই। সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর সেখানে পচন ধরলে পা কেটে ফেলতে হয়। এরপর হতাশায় ডুবে ছিলাম। কিন্তু ব্র্যাক থেকে যখন কৃত্রিম পা লাগানো হলো তখন মনে সাহস পেলাম। এখন আমি নিজে নিজে চলতে পারি। এখন স্বপ্ন দেখছি, লেখাপড়া চালিয়ে যাব। দেশের জন্য কাজ করতে চাই।’

বিজ্ঞাপন
জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ হারানো ওমর ফারুক বলছেন ‘দেশের প্রয়োজনে আন্দোলনে ছিলাম’। ছবি: সারাবাংলা

জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ হারানো ওমর ফারুক বলছেন ‘দেশের প্রয়োজনে আন্দোলনে ছিলাম’। ছবি: সারাবাংলা

অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এই কিশোর বলেন, ‘গণহত্যায় জড়িত সকলের বিচার দাবি করছি। বর্তমান যে সরকার আছে, তারা যেন দেশটাকে সঠিকভাবে চালায় সেই আশা করছি। দেশের প্রয়োজনে আবারও রাজপথে নামব।’ বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে তামিম বলেন, ‘আমি কিশোর বয়সী হলেও যখন দেখলাম আমার ভাই বোনেরা গুলি খাচ্ছে, রাজপথে মরছে, আহত হয়ে কাতরাচ্ছে তখন আমি আর ঘরে থাকতে পারিনি। কোনোরকম মা’কে ম্যানেজ করে রাজপথে থেকেছি। আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। এক পা গেছে, অন্য পা গেলেও আন্দোলনে থাকতাম। জীবনটা দিতে নেমেছিলাম। পা যাক, তবুও স্বৈরাচারী হাসিনার পতন হয়েছে এটাই বড় পাওয়া।’

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেছিলেন জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ হারানো ২১ বছরের উড়ন্ত যুবক ওমর ফারুক। তিনি বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেক্ট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ সেমিস্টারে পড়তেন। জুলাই আন্দোলনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে গাজীপুরের সখীপুরের নিজ বাড়িতে ছিলেন। ৪ আগস্ট প্রবল আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন ওমর ফারুক। আনসার একাডেমির সামনে বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা মিলে গুলি ছুড়তে থাকে। তখন পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হন তিনি। এর পর তাকে একটি বেরসকারি হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। ওমর ফারুকের ছোট ভাই ফরহাদ ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালে যাওয়ার পর দেখি তার পুরো শরীর ঝাঝরা হয়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শুধু গুলি আর গুলি। ডাক্তার জানায়, দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বাবা রিকশা শ্রমিক আর মা গৃহিনী। বড় ভাই পড়ালেখা করে কিছু একটা করবেন সেই আশা ছিল। কিন্তু সেটা মুহূর্তেই ধুলিসাৎ। চোখ হারানোর পর সারজিস আলম সাক্ষাৎ করে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এর পর জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আর চিকিৎসা সেবা সরকারিভাবে করা হচ্ছে।’

দুই চোখ হারানো ওমর ফারুক বলেন, ‘দেশের প্রয়োজনে আন্দোলনে ছিলাম। বেঁচে আছি এটা শুকরিয়া। গুলিতে অনেক ভাইয়ের মতো মারাও যেতে পারতাম। সরকার যেন আমাদের দিকে আরও ভালোভাবে দেখে সেই প্রত্যাশা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনসহ ১৫ বছরে যারা গুম খুন আর গণহত্যার সাথে জড়িত ছিলেন তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। সেইসঙ্গে শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের আওতায় আনার দাবিও করছি। না হলে আমরা কেউই শান্তিতে ঘুমাতে পারছি না।’

হৃদি, ওমর ফারুক ও তামিমের মতো শত শত গুম খুনের শিকার ও জুলাই আন্দোলনে আহতরা উপস্থিত হয়েছেন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে উপস্থিতদের একটাই দাবি, শেখ হাসিনাকে দেশে এনে আদালতের মাধ্যমে বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি কার্যকর করা। পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িতদেরও বিচারের দাবি জানান তারা।

সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস খুন গুম জুলাই আন্দোলন মায়ের ডাক সমাবেশ হৃদি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর