‘মৃত্যুরোধে দ্রুত ক্যান্সার শনাক্তের ব্যবস্থা জরুরি’
১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:২২
ঢাকা: স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেছেন, আমাদের দেশে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এখন ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। তবে আমাদের দেশে ক্যান্সার আর্লি ডিটেকশন বা তাড়াতাড়ি শনাক্তের ব্যবস্থা করা দরকার। সেটা এখনো আমাদের দেশে নাই। এর ফলে আমাদের কাছে যে রোগীরা আসে তারা স্টেজ-৩ বা স্টেজ-৪ পর্যায়ে থাকে। তার মানে এটার একটা বড় সমস্যা। এর ফলে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও কমে আসবে।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশ, অগ্রগতি ও সম্ভাবনা শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।
সূচনা বক্তব্যে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে যে সব রোগীরা দেশের বাইরে যাচ্ছেন তাদের সিংহভাগই ক্যান্সার রোগী। এর ফলে প্রায় পাঁচ থেকে সাত বিলিয়ন ডলার আমাদের দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক দরিদ্র মানুষের কষ্টে অর্জন করা টাকা আমরা অন্য দেশে বিলিয়ে দিয়ে আসছি। এটা কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য একটি ক্ষতিকর দিক। এর সমাধান কী ভাবে আমরা করবো তা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশে ক্যান্সারের পরিস্থিতি অনুযায়ী দেড় লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। যেহেতু আমাদের দেশে সঠিক কোনো ক্যান্সার রেজিস্ট্রি নাই তাই সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আমাদের দেশে নাই।’
দেশের বিভিন্ন ক্যান্সার আক্রান্ত ও চিকিৎসা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে পুরুষদের অন্যতম ক্যান্সার হচ্ছে ফুসফুসের ক্যান্সার। আগে আমাদের দেশে ফুসফুসে আক্রান্ত ক্যান্সার রোগীরা যেখানে বাঁচতো দেড় বছর তারা এখন আট বছর বা তার বেশি বাঁচছে। অত্যাধুনিক চিকিৎসা থাকার কারণে এমনটা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশেই এখন বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আমাদের রোগীরা যখন ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অন্য দেশে যায় তখন সেখানেও কিন্তু বলা হয় বাংলাদেশে দেওয়া চিকিৎসা ঠিক আছে। এর মানে ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়ার দরকার নাই।’
ডা. আকরাম বলেন, ‘আমাদের দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এটা সারা পৃথিবীতেই মেয়েদের অন্যতম রোগ। তরুণীদের মাঝে এটা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। কিন্তু এর চিকিৎসার জন্য কি দেশের বাইরে যাওয়া জরুরি? খুব একটা বেশি জরুরি না। কেমো, টার্গেট থেরাপি বা ইমিউনো থেরাপি দেওয়ার জন্য কাউকে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নাই।’
তিনি বলেন, ‘জরায়ু মুখের ক্যান্সারের জন্যও আসলে দেশের বাইরে যাওয়ার দরকার নাই। এছাড়াও তামাকজনিত কারণে হওয়া নানা ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যেও বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। এর মানে আসলে আমাদের দেশে কি নাই? প্যালিয়েটিভ সার্ভিসও আমাদের দেশে আছে। এমনকি আমাদের দেশে বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিশ্বের উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন ওষুধ পাওয়া যায়। বাইরে যে ওষুধ লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হয় সেটা এখানে স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়।’
দেশের ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নানা অসুবিধার বিষয়ে ডা. আকরাম বলেন, ‘বাংলাদেশ কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অসুবিধা হলো পরিমাণমতো রেডিওথেরাপি মেশিন না থাকা। যেসব মেশিন আছে সেগুলোর মাঝে কতটা ঠিক অবস্থায় আছে তাও একটা বিষয়। কিন্তু মেশিনগুলোর যে দাম তাতে সরকারিভাবে সব স্থানে সরবরাহ করা খুব কষ্টসাধ্য। বেসরকারি অনেক হাসপাতালে অবশ্য অনেক অত্যাধুনিক মেশিন আছে। এক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া যায় কিনা সেই বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।’
এ দিন বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়কারী ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
তিনি বলেন, ‘দেশে একটা পরিবর্তন আসছে। সব খাতেই সংস্কারের বিষয়ে জনগণের চাহিদা ও সরকারের উদ্যোগ আছে।বিগত সময়ের সরকার ব্যবস্থা যেভাবে চলেছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেভাবে চলেছে সেখানে পরিকল্পনার অভাব থেকে শুরু করে দূর্ণীতিসহ নানামুখী সমস্যা ছিল। এখন সেখানে মানুষের আকাঙ্ক্ষা অন্যান্য খাতের মতো স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আসবে যা গণমুখী হবে। স্বাস্থ্য সংস্কার হয়েছে ইতোমধ্যেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে শুধুমাত্র চিকিৎসা করে ক্যান্সার নির্মূল করা সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ। এর জন্য জরুরি চারটি ধাপের মাঝে অন্যতম প্রাথমিক প্রতিরোধ অর্থাৎ সূচনা বা শুরুর দিকেই ক্যান্সার শনাক্ত করা। এছাড়া চিকিৎসার পাশাপাশি প্রশমন সেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ডা. তালুকদার বলেন, ‘১৯৯৩ সালে যখন বর্তমান ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে আমরা যোগ দেই তখন সেটা ৫০ শয্যার একটা হাসপাতাল ছিল। তারও আগে পঞ্চাশের দশকে ক্যান্সার চিকিৎসায় অন্যতম পদ্ধতি যাকে আমরা বিকীরণ পদ্ধতি বা রেডিয়েশন থেরাপি শুরু হয় কুমুদিনী হাসপাতালে। পরবর্তীতে ঢাকা, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজসহ অন্যান্য স্থানে শুরু হয়। পরবর্তীতে রোটারীর সাহায্যে ক্যান্সার ডিটেকশন ইউনিট হয় মহাখালীতে যেখানে সরকার জায়গা দেয়। তখন রেডিওথেরাপির জন্য আমরা ঢাকা মেডিকেলে রেফার করতাম। সেখান থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বলতে পারি ক্যান্সার চিকিৎসায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি আমাদের জনবলও বাড়ছে। কারিগরি দিকেও আমরা যথেষ্ট উন্নতি করেছি।’
তিনি বলেন, ‘আইএআরসি’র (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার) সর্বশেষ ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে নতুন করে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন (আনুমানিক) ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে প্রতি বছর এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। গ্লোবোক্যানের হিসেবে আমাদের দেশের প্রধান তিনটা ক্যান্সার হলো, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, ঠোট ও ওরাল ক্যান্সার এবং ফুসফুসের ক্যান্সার। মেয়েদের মাঝে স্তন, জরায়ুমুখের ক্যান্সার ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার উল্লেখযোগ্য। সংস্থাটির হিসেবে প্রতি লাখে বাংলাদেশে ১০৫জন ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে এটা আমাদের দেশে করা কোনো গবেষণার ভিত্তিতে দেওয়া তথ্য না। আশেপাশের দেশের বিবেচনায় একটা আনুমানিক ধারণা মাত্র।’
তিনি আরও বলেন, ‘শয্যাসংখ্যা, আধুনিক যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক, নার্সসহ সহায়ক জনবল বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকর কৌশলপত্র নেই। আমাদের একটা ন্যাশনাল ক্যান্সার প্ল্যান অফ একশন বা কর্মপরিকল্পনা নাই। জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মকৌশলও নাই। এছাড়াও জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন কর্মসূচি ও স্ক্রিনিং কর্মসূচিও নাই।’
গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক এবং বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি হাসপাতাল এন্ড ওয়েলফেয়ার হোম প্রেসিডেন্ট ডা. আবদুল হাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, দেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ অন্যান্যরা।
সারাবাংলা/এসবি/এসআর