ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতে নাজেহাল উত্তরের জনপদ
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:২১ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:২৬
রংপুর: ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতে নাজেহাল উত্তরের জনপদের প্রায় এককোটি মানুষ। শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত জনপদে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ঘটেছে ছন্দপতন। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে চরাঞ্চলসহ কৃষক-শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষজন। এই শীতের দাপট থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই খড়খুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হচ্ছেন, ঘটেছে বিয়োগান্তক ঘটনাও।
এদিকে সূর্যের দেখা না মেলায় দিনের অধিকাংশ সময়ই ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে এতে বেড়েছে শীতজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ, চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। দেখা দিয়েছে শীতবস্ত্রের অভাব। এদিকে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে মাসজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ, হাড়কাঁপানো শীত নিয়ে দুঃসংবাদ।
সাধারণত হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় রংপুর অঞ্চলে শীত যেমন আসে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে একটু আগেভাগেই, তেমনি শীতের তীব্রতায় ভোগান্তির শিকার হয় এ অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি। রংপুর অঞ্চলে অক্টোবরের নভেম্বরের শুরু থেকে শীতের আমেজ চলছে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ১২-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। ঘন কুয়াশা আর শীতের তীব্রতা যেনো মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রংপুরের প্রকৃতি সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকছে। কোনো কোনো দিন সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায়না। সব মিলিয়ে শীত এবং হিমেল হাওয়ায় জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
রোববার (১৫ ডিসেম্বর) সরেজমিন নগরির শাপলা চত্তর, মডার্ণ মোড়, মেডিকেল মোড়সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভর দুপুরেও সড়ক-মহাসড়কে লাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করছে।
কুয়াশা ও ঠাণ্ডার কারণে স্বাভাবিক দিনের চেয়ে নগর জীবনের ব্যস্ততা বেড়েছে একটু দেরি করেই। বাড়ির সামনে আগুন জ্বালিয়ে শিশু ও বৃদ্ধ মহিলারা শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। ঘন কুয়াশায় সকাল থেকেই কর্মব্যস্ততায় জড়িয়ে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ। কৃষক, দিনমজুর, ভ্যানচালকরা কাজে বেরিয়েছে। অনেকেই আবার এখনো ধান মাড়াই নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। দিন দিন কুয়াশার সঙ্গে ঠাণ্ডার মাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকেই ঠাণ্ডা বাতাসে শীত লাগতে শুরু করেছে। শীতের মোটা গরম কাপড় পরতে হয়েছে। রাতে টিনের চালে টিপটিপ করে শিশির পড়ে বৃষ্টির মতো।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, রোববার (১৫ ডিসেম্বর) রংপুরে সকাল সাড়ে ৭টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, জলবাযু পরিবর্তনের ফলে উত্তরাঞ্চলে অঞ্চলে শীতের সময় প্রচণ্ড শীত এবং গরমের সময় প্রচণ্ড গরম অনুভব হয়। গত কয়েকদিন ধরে এ অঞ্চলে শীত তার আপন রূপে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
তিনি বলেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রকৃতিতে কুয়াশার পরিমান বেড়ে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যে এই অঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
এবছর শীতের অনুভূতি গতবারের চেয়ে বেশি হবে–কারণ হিসাবে তিনি বলেন, কুয়াশা এবং অতি বৃষ্টি। বাতাসে অনেক ধুলাবালি থাকায় কুয়াশাটা বেশি হবে এবং শীতও বেশি লাগবে। সেইসাথে, এ বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি ছিল। বেশি শীতের এটাও কারণ।
এদিকে দিনে যেমন তেমন থাকলেও, রাতে তাপমাত্রা দ্রুত কমছে। গত কয়েকদিন থেকে আকাশ রয়েছে মেঘলা। শীতের কারণে খেটে খাওয়া দিনমজুর শ্রেণির মানুষ কাজ না পেয়ে বেকায়দায় রয়েছেন। ফলে হতদরিদ্ররা পড়েছেন বিপদে। বিশেষকরে গ্রামাঞ্চল ও চর এলাকার লোকজনের শীতবস্ত্রের অভাবে থাকেন। শীতে কাবু হয়ে অনেক দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষকে শীতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কয়েকদিনের ব্যাবধানে শীত ও ঘন কুয়াশার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শীতের এই পরিস্থিতিতে মানুষের পাশাপাশি গরু-ছাগলসহ গবাদিপশুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাবের পরিমাণ বেশি।
এদিকে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর অঞ্চলের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুর জেলার চরাঞ্চলসহ কৃষক-শ্রমিক, ছিন্নমূল মানুষ ও খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। দেখা দিয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব। একদিকে শীতবস্ত্র সংকট অন্যদিকে বিভিন্ন রোগ-বালাই নিয়ে বিপাকে পড়েছে শিশু-বৃদ্ধসহ নারী-পুরুষরা।
নগরীর শাপলা চত্তরের রিকশাচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘গত দুই-তিন দিন ধরে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। কুয়াশাও পড়ছে সেই রকম। এতে যাত্রী নেই বললেই চলে দিনের বেলায়। রাতে আর সকালে যাত্রী তেমন পাওয়া যায় না। শীতের কারণে রিকশা ঠিকভাবে চালানো যায় না। ফলে আয় উপার্জন কমে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে সংকটের মধ্যে রয়েছি।’
পার্কের মোড়ের রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আগের থেকে অনেক বেশি ঠাণ্ডা পড়েছে। শীতের কারণে রিকশায় আর কেউ যাতায়াত করেনা। অটোরিকশাচালকদের কদর বেড়েছে।’
আর ভ্যান চালক মজিবুর রহমান বলেন, ‘কষ্ট হলেও নিজের জীবিকার তাগিদে ভোরেই ভ্যান নিয়ে বের হতে হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে বেশি ঠাণ্ডা পড়েছে। তবুও বের হয়েছি। কারণ উপার্জন না হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে কেমনে চলব।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শীত মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১ লাখ ৪ হাজার শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হলেও সোমবার (৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১ হাজার ৬০০ শীতবস্ত্র।
এদিকে রাতে ঠাণ্ডা ও দিনে হালকা পরিমাণে গরম হওয়ায় বেড়েছে শীতজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি। প্রতিটি ঘরে ঘরে সর্দি, কাশি ও জ্বর হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ এ অঞ্চলের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বাড়তে শুরু করেছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। নিউমোনিয়া, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ে ভর্তি হচ্ছে রোগীরা। বিশেষ করে এই শীত থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই খড়খুটে জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হচ্ছেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটেও বাড়ছে আগুন পোহাতে দিয়ে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা। গত বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) জবা বেগম নামে এক নারী মারা গেছেন। তিনি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ওসমানপুরের বাসিন্দা। আর গত এক সপ্তাহে আগুন পোহাতে গিয়ে ৫ নারী আগুনে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হাওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে এবং আরও দুজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এ বিষয়ে রমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক শাহিন শাহ জানান, এবারের শীতে পাঁচ নারী দগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে একজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আরও দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
তিনি জানান, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে ১৪টি বেড রয়েছে। কিন্তু বিভিন্নভাবে আগুনে পোড়া রোগী ৪৬ জন ভর্তি রয়েছে। এসব পোড়া রোগী অন্যান্য ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘শীতের কারণে শিশুরা ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসছে। চিকিৎসকরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন চিকিৎসা দেয়ার।’
সারাবাংলা/এনজে