যুদ্ধদিনের গল্প
‘অস্ত্র নেব, না খাবার নেব— অস্ত্র না নিলে যুদ্ধ করব কীভাবে’
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:০৬ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:২৩
খুলনা: ‘যুদ্ধের সময় খাবার সঙ্গে করে নিতে হতো। এক পর্যায়ে বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, সঙ্গে অস্ত্র নেব, না খাবার নেব। অস্ত্র নিলে খাবার কম হয়ে যায়। আবার খাবার বেশি নিলে অস্ত্র নিতে পারি না। কিন্তু অস্ত্র না নিলে যুদ্ধ করব কীভাবে। গোলাবারুদ সবকিছু নিতে হতো। সেগুলো খুব ভারী ছিল।’— এভাবেই সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয় দিবসের দুপুরে যুদ্ধকালীন বর্ণনা দিচ্ছিলেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা হরশিত বিশ্বাস (৮৬)। তিনি রূপসা উপজেলার ৫ নম্বর ঘাটভোগ ইউনিয়নের বাসিন্দা।
খুলনার রূপসা উপজেলা পরিষদের ভেতরে সারাবাংলার প্রতিবেদকের কাছে যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছিলেন হরশিত বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার অনুপ্রেরণা কীভাবে পেয়েছিলেন? জানতে চাইলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি তখন বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট স্কুলে পড়াশোনা করি। মোল্লারহাটের এম এ খায়েরের নেতৃত্ব আমরা আট জন ছেলে বর্ডার পার হয়ে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে চলে যাই। ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর আমাদের অস্ত্র দেয়। পরে আমরা সাতক্ষীরা বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি এলাকায় নদী-নালা খুব বেশি। পারাপারেও খুব অসুবিধা। সেখানকার রাস্তাঘাটও ঠিকমতো চিনতাম না। যে কারণে সেখান থেকে আমরা আবার ক্যাম্পে ফিরে গিয়েছিলাম।’
তিনি বলতে থাকেন, ‘ক্যাম্পে ফিরে সেখান থেকে ঝিনাইদাহ মহেশপুর থানার বাগাডাঙ্গা বাজার হয়ে ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। ভারতীয় সৈন্যরা ট্যাংক, কামানসহ ভারী ভারী অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। আমাদের দিয়েছিল গ্রেনেড, হালকা মেশিনগান ও স্টেনগান। আমাদের ওই অস্ত্র চালানোরই ট্রেনিং ছিল। পাকিস্তানি সেনাদেরও ছিল ভারী ভারী অস্ত্র। যে কারণে ভারতের সৈন্যদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। আর আমরা ভারতীয় সৈন্যদের সুরক্ষা দিতে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যশোর সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিল। গেট বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন আমরা বুদ্ধি করলাম যে, গরম পানি দিয়ে সেনানিবাস শত্রুমুক্ত করতে হবে। যখন গরম পানি দেওয়া শুরু হলো তখন পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সেখান থেকে আমরা চলে যাই খুলনার শিরোমনি। সেখানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এর পর আমাদের অন্য জায়গায় চলে যেতে বলা হয়। তখন আমরা খুলনায় এসে একটি ক্লাব ঘরে আশ্রয় নিই। ক্লাব ঘরটি ছিল সোসাইটি হলের পাশে। আমরা সেখানে সাত দিন ভাত না খেয়ে ছিলাম। আমাদের কাছে হালকা খাবার ছিল। তাই খেয়েছিলাম।’
হরশিত বিশ্বাস বলতে থাকেন, ‘আমি যুদ্ধে রাইফেল ব্যবহার করতাম। সেখান থেকে আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে খুলনার তেরখাদা উপজেলায় চলে আসি। খুলনা স্বাধীন হয়ে গেল। সব জায়গা স্বাধীন। পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করল। তখনও তেরখাদা মুক্ত হয়নি। তেরখাদার যত রাজাকার তারা কাটেঙ্গা হাইস্কুলে দোতলায় আশ্রয় নিয়েছিল। স্কুলটা ছিল ফাঁকা মাঠের মধ্যো। কাছে কোনো বাড়িঘর ছিল না। আমরা তখন পানির মধ্য দিয়ে আবর্জনা মাথায় তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলাম। একসঙ্গে আমরা ১৮ জন পাটগাছ ও ধনচের আড়ালে থেকে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলাম। সেজন্য ওরা টার্গেট করে আমাদের ওপর সেভাবে আক্রমণ করতে পারেনি। কিন্তু আমাদের গুলির আঘাতে স্কুল ভবন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। তিন দিন আমরা স্কুলটি ঘিরে রেখেছিলাম। ওই তিনদিন ওদের খাওয়া-দাওয়া সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। পরে কোনো উপায় না পেয়ে তারা আত্মসমর্পণ করে।’
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ শেষে যে বেঁচে ফিরব সে কথা কখনও ভাবিনি। এমনকি কী পাব, বা না পাব- সেটাও মাথায় আসেনি। মাথায় ছিল শুধু দেশকে মুক্ত করার চিন্তা। সেই চিন্তা ও চেতনা থেকেই যুদ্ধে যাই এবং দেশ স্বাধীন করি। কিন্তু এখন যখন সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান করে তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়।’
সারাবাংলা/পিটিএম