নওগাঁর পিপি রফিকুলকে হাইকোর্টে তলব
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৯:৩৯
ঢাকা: বিচার বিভাগ নিয়ে আদালত অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে নওগাঁর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবু জাইদ মো. রফিকুলকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ৬ জানুয়ারি নওগাঁর পিপি রফিকুলকে সশরীরে আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে তাকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও দেবাশীষ রায় চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন।
নওগাঁর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রবিউল ইসলাম আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তানিম খান।
নওগাঁ পিপি রফিকুল প্রকাশ্যে বিচারক ও বিচার বিভাগ নিয়ে আদালত অবমাননাকর বক্তব্য দেন। এরপর এ ঘটনায় গত ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর পিপির বক্তব্য যুক্ত করে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রবিউল ইসলাম আবেদন করেন। এতে প্রতিস্বাক্ষর করেন নওগাঁয় দায়িত্বরত সাত জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
পরে আবেদনটি প্রধান বিচারপতির নজরে আনা হয়। এরপর আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আবেদনটি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন প্রধান বিচারপতি। সে অনুসারে আবেদনটি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হলে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে নওগাঁর পিপি রফিকুলকে তলব করেন।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রবিউল ইসলামের আবেদনে বলেছেন, ‘গত ২৭ নভেম্বর নওগাঁ সদর আমলী আদালতের দায়িত্ব পালনকালে জিআর ৩৯৬/২৪ (নওগাঁ সদর), জিআর ৪৫৩/২৪ (নওগাঁ সদর) ও জিআর ৩৬০/২৪ (নওগাঁ সদর) মোকদ্দমায় কয়েকজন আসামি আত্মসমর্পণপূর্বক জামিনের আবেদন করলে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষকে শুনানিঅন্তে আসামিদের জামিন পুলিশ রিপোর্ট দাখিল পর্যন্ত মঞ্জুর করি। এজলাসে খুব স্বাভাবিকভাবেই কার্যক্রম চলেছিল। ওই দিনই আদালতের কার্যক্রম শেষে আমি আমার ভাড়া বাসাতে ফিরে যাওয়ার পর রাত ৯টার দিকে নওগাঁর পাবলিক প্রসিকিউটর আবু জাইদ মো. রফিকুলের বক্তব্যের একটি ভিডিও ফুটেজ আমার ব্যবহৃত হোয়াটস অ্যাপে আসে।’
ভিডিওটিতে দেখা যায়, চট্টগামের বিজ্ঞ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বক্তব্য প্রদানকালে বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটর অপ্রাসঙ্গিকভাবে এবং সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ নওগাঁতে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রকাশ্যে হুমকি প্রদান করেন।
বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটর তার বক্তব্যে বলেন, ‘…… বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলবো- জুডিসিয়ারি কিলিং, ন্যায়বিচারের পরিপন্থি আপনারা অনেক বিচার করেছেন।….. আমি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ জুডিসিয়াল সকল বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলবো—আপনারা আওয়ামী লীগের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। আমি এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবি, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের বলবো— আপনারা আমার কথা লিপিবদ্ধ করবেন, সরকারকে জানাবেন। নওগাঁতে কিছু বিচারক আছেন, সে সকল বিচারক আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীর ভাগিনা, ভাতিজা। …… বিচারকরা ভালো ব্যাখ্যা দেন। বদমায়েশী করার জায়গা পান নাই? জনতা-ছাত্র বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে খুনি হাসিনা হিন্দুস্তানে পালিয়েছে। আপনাদের পালানোর জায়গা হবে না। ….. বিচারকদেরকে আবারো বলবো, ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে আবারও বলবো…… যদি আপনাদেরকে ঘেরাও করে তার দায়-দায়িত্ব আপনাদেরকে নিতে হবে। …..বাংলাদেশে চাকরি করবেন, আওয়ামী লীগের দালালি করবেন; চাকরি করতে দেবো না, ঘেরাও করা হবে।’
আগামীতে যদি কোনো সন্ত্রাসী লীগের কোনো কর্মী, কোনো নেতা যে আদালতে আত্মসমর্পণ করবে, সেই আদালত ঘেরাও করা হবে।…..প্রিয় ভাইয়েরা, বিচারককে আমি নাম ধরে বলতে চাচ্ছি না, এখনও সাবধান হয়ে যান এবং আগামীতে এই রকম কর্মকাণ্ড যদি আপনারা অব্যাহত রাখেন, আপনাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাসহ, আইনজীবীসহ আপনাদেরকে ঘেরাও করা হবে। আজকে আমিও শুনলাম, সদর কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট অনুপস্থিতিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট নাম রবিউল ইসলাম। যার মামা ঈশ্বরদী শরিফুল ইসলাম ডিলু, সে ভূমিমন্ত্রী ছিল। তার ছেলে ২২ সালের মন্ত্রী, এমপি গেল ভোটে, পরে তাকেও ভূমি প্রতিমন্ত্রী দেওয়া হয়েছে। তার আত্মীয় এখানে ম্যাজিস্ট্রেট।’
বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটরের বক্তব্য স্বাধীন বিচারকার্যে নগ্ন হস্তক্ষেপ ব্যতীত কিছু নয় এবং তিনি আদালত ও বিচারককে ঘেরাও করার হুমকি প্রদানের মাধ্যমে ‘Cannons of Professional Conduct and Etiquette framed under Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order, 1972’ এর অধীনে অসদাচরণের অপরাধ করেছেন।
প্রকাশ্যে বিচারপ্রার্থীসহ সাধারণ মানুষের সম্মুখে আদালত ও বিচারকদের নিয়ে বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটরের দেওয়া বক্তব্য জন-সাধারণের মধ্যে নওগাঁ ম্যাজিস্ট্রেসি তথা বিচার বিভাগ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যা আদালত অবমাননার সামিল। এ ছাড়া আমাকে ঈশ্বরদী, পাবনা আসনের সাবেক এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর ভাগিনা দাবি করে দেওয়া তার বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অমূলক।
শামসুর রহমান শরীফ ডিলু কিংবা তার ছেলের সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ বা কথাও হয়নি; আত্মীয়তা দূরে থাক।
এমতাবস্থায়, আমিসহ নওগাঁ ম্যাজিস্ট্রেসিতে কর্মরত নিম্ন প্রতিস্বাক্ষরকারী অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেটবৃন্দ স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।
বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটর কর্তৃক কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটদের আদালত ঘেরাও করাসহ আদালত অবমাননাকর বক্তব্যের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে নওগাঁতে স্বাধীনভাবে বিচার কার্য পরিচালনা বাধাগ্রস্থ হবে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এইচআই