পেলিকোট গণধর্ষণ মামলায় ৫১ আসামির বিরুদ্ধে রায় আজ
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:২০ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৪
ফ্রান্সের পেলিকট গণধর্ষণ মামলার রায় বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর)। আভিনিও শহরের একটি আদালত এই লোমহর্ষক মামলার ৫১ জন অভিযুক্তের রায় ঘোষণা করবে। ৭২ বছর বয়সী গিসেল পেলিকট, যিনি এই মামলার অভিযোগকারী তার সাহসিকতায় পরিণত হয়েছেন নারীবাদী আইকনে।
প্রায় এক দশক ধরে গিসেল পেলিকটকে তার প্রাক্তন স্বামী ডমিনিক পেলিকট (৭২) পরিকল্পিতভাবে ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করতেন। এরপর তিনি অনলাইনে পরিচিত বিভিন্ন পুরুষকে আমন্ত্রণ জানাতেন, যারা গিসেলকে তার অজান্তে ধর্ষণ করত।
ডমিনিক পেলিকট নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি গিসেলের খাবার এবং পানীয়ের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে অচেতন করতেন। এই ঘটনা ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল।
দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে গিসেল স্মৃতি হারানো, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ার সমস্যায় ভুগতে থাকেন। তার জীবনের প্রায় ১০ বছরকে তিনি হারিয়ে যাওয়া সময় বলে উল্লেখ করেছেন।
ডমিনিক পেলিকট তার কৃতকার্যের জন্য ধরা পড়েন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অপরাধের জন্য। একদিন তিনি একটি সুপারমার্কেটে নারীদের স্কার্টের নিচের ছবি তোলার চেষ্টা করার সময় নিরাপত্তা কর্মীরা বিষয়টি লক্ষ্য করলে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ তার ঘর থেকে এই ঘটনার প্রমাণ উদঘাটন করেন।
তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ডমিনিক একটি নিষিদ্ধ ওয়েবসাইট ব্যবহার করতেন। যা ব্যবহার করে তিনি স্থানীয় পুরুষদের আমন্ত্রণ জানাতেন, যারা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করত।
মামলার ৫১ জন অভিযুক্ত বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন পেশার। এদের বয়স ২৭ থেকে ৭৪ বছরের মধ্যে। তারা দমকলকর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, ট্রাক চালকসহ বিভিন্ন পেশার এবং বেশিরভাগই ঐ এলাকার ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করেন।
অভিযুক্তদের মধ্যে রোমান ভি (৬৩) নামে একজন ধর্ষণের ছয়টি ঘটনায় অভিযুক্ত। তিনি এইচআইভি পজিটিভ ছিলেন। তার জন্য ১৮ বছরের কারাদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে, একজন অভিযুক্ত, ৬৯ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত ক্রীড়া প্রশিক্ষক জোসেফ সি’র বিরুদ্ধে ধর্ষণের পরিবর্তে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তার জন্য চার বছরের শাস্তি প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সবচেয়ে কম।
ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী, গিসেল পেলিকট চাইলে মামলাটি বন্ধ দরজার পেছনে পরিচালনার আবেদন করতে পারতেন। তবে এর পরিবর্তে, তিনি এটি প্রকাশ্যে পরিচালনার আবেদন করেন। তার মতে, এটি অন্য নারীদের সামনে এগিয়ে এসে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে উৎসাহিত করবে এবং প্রমাণ করবে যে ভুক্তভোগীদের লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেছেন, ‘আমি চাই, ধর্ষণের শিকার প্রত্যেক নারী আমার দৃষ্টান্ত দেখে বলুক, পেলিকট পেরেছেন, আমিও পারব।’
এই মামলার মাধ্যমে ফ্রান্সে ধর্ষণের সংজ্ঞা এবং সম্মতির আইন নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রসিকিউটর লর শাবো বলেন, ‘যেহেতু সে কিছু বলেনি, তার মানে সে সম্মতি দিয়েছে- এই ধারণা থেকে বের হতে হবে।’
ফ্রান্সে ধর্ষণের জন্য গড় শাস্তি এগারো বছর। তবে এই মামলায় প্রসিকিউটররা চার থেকে বিশ বছরের কারাদণ্ডের আবেদন করেছেন।
এই মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ডমিনিক পেলিকট নিজেই ধর্ষণের ভিডিও প্রমাণ ধারণ করেছিলেন। সেই ভিডিওগুলো আদালতে প্রদর্শিত হয়েছে। এর ফলে অভিযুক্তদের পক্ষে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে অনেক অভিযুক্ত দাবি করেছেন, তারা জানতেন না গিসেল অচেতন ছিলেন। তাদের আইনজীবীরা বলেছেন, অভিযুক্তদের অনেকেই সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং অপরাধী হিসেবে তাদের চিহ্নিত করা ঠিক নয়।
এই মামলার রায় ঘোষণার আগে ফ্রান্সজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছে। ফ্রান্সে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এই মামলাকে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে দেখছে। ‘ডেয়ার টু বি ফেমিনিস্ট’ সংগঠনের এলসা লাবুরেট বলেন, ‘গিসেল এই ঘটনাকে শুধু নিজের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত বিষয় করে তুলেছেন।’
গিসেল পেলিকট বলেছেন, ‘আমাকে কাপড়ের পুতুলের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। এটা যৌনতা নয়, এটা ধর্ষণ।’ তার সাহসিকতা এবং এই মামলার প্রকাশ্য বিচার ফ্রান্সের ধর্ষণ আইনে পরিবর্তনের দাবি তীব্রতর করেছে।
আজকের রায় শুধু এই মামলার আসামিদের শাস্তি নয়, বরং ফ্রান্সে ধর্ষণের সংজ্ঞা এবং নারীর সম্মানের বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবে।
সারাবাংলা/এনজে