হলুদ রাজ্যে মধু ছাড়ছে মৌমাছি, বাম্পার ফলন দেখাবে সরিষা
২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০০ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৩১
সিরাজগঞ্জ: জেলার নয়টি উপজেলার ফসলের মাঠে হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে হলুদ সরিষা। দূর থেকে সরিষার ক্ষেতগুলো দেখলে মনে হয়, কে যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। সরিষা ফুলের হলুদ রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত মাঠ। রোদ ঝলমল আলোয় প্রকৃতির মাঝে অপরূপ সৌন্দর্যের শোভা ছড়াচ্ছে হলুদ সরিষা। এদিকে শীতের কুয়াশাকে উপেক্ষা করে সরিষা ক্ষেতের যত্ন নিচ্ছেন চাষীরা। কোথাও কোথাও আবার মধু সংগ্রহের জন্য বসানো হয়েছে কৃত্রিম চাক। এবারও জেলায় ৪০০ টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরে রেখেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। পাশাপাশি সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে কৃষি প্রণোদনা পাওয়ায় জেলায় এবার সরিষার চাষ বেড়েছে। জেলার নয়টি উপজেলায় ৮৬ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। যদিও এবার চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার হেক্টর। তবে বিগত বছরের তুলনায় এবার ১ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ বেড়েছে। এ বছর কৃষি কর্মসূচির আওতায় ৮২ হাজার ৬০০ জন কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৭১ হাজার কৃষকই সরিষা চাষে প্রণোদনা নিয়েছেন।
সরিষা চাষীরা জানান, গতবছর আশানুরূপ দাম পাওয়ায় এবং কৃষি বিভাগ সরিষা চাষে প্রণোদনা দেওয়ায় চলতি মৌসুমেও সরিষা চাষে আগ্রহী হয়েছেন তারা। এ বছর জেলায় সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন।
রায়গঞ্জ উপজেলার খামারগাতী গ্রামের কৃষক জব্বার সেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর দুই বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলাম। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছিল ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। ফলন পেয়েছিলাম ১২ মণ। প্রতি মণ সরিষা তিন হাজার দরে ৩৬ হাজার টাকা বিক্রি করেছিলাম। এবারও ৪ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। আশা করছি এবারও ভালো ফলন হবে। দামও ভালো পাব।’
সলঙ্গার রামকৃঞ্চপুর গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেন সারাবাংলাকে জানান, এবার তিনি ছয় বিঘা জমিতে রবি সরিষার আবাদ করেছেন। এ জন্য কৃষি অফিস থেকে সার-বীজ পেয়েছেন। তার জমিতে আগাম সরিষার ফুলে ভরে গেছে। তিনি আশা করছেন প্রতিবছরের মতো এবারও ভালো ফলন হবে।
তিনি আরও জানান, আগে অনেক কৃষক সরিষা চাষ করতেন। আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় তারা চাষ কমিয়ে দিয়েছিলেন। বাজার দর তিন হাজার টাকার বেশি থাকলে কৃষকেরা সরিষা চাষে আরও বেশি উৎসাহী হবেন বলে মন্তব্য করেন এ কৃষক।
উল্লাপাড়ার পুর্ণিমাগাঁতী গ্রামের কৃষক নয়ন শেখ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর চার বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলাম। এ বছর কৃষি বিভাগ থেকে বীজ ও সার প্রণোদনা পাওয়ায় ১০ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। গত বছর সরিষার ফলন ভালো ছিল, দামও ভালো পেয়েছি। এবার প্রতি বিঘা জমিতে ৬-৭ মণ সরিষা পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’ গতবছর সরিষার পরে বোরো লাগানোর কারণে ধানের ফলনও ভালো হয়েছিল বলে জানান তিনি।
অপরদিকে, ফসলের মাঠ হলুদ ফুলে ঢেকে যাওয়ায় মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণ করতে এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েক শতাধিক মৌচাষী। তরা কৃষকদের জমির পাশে মৌমাছির কৃত্রিম চাক পেতে বসেছেন। বাক্সে থাকা মৌমাছির দল সরিষার ফুল থেকে ফুলে গুন গুন শব্দে মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছে।
সলঙ্গা থানার হাটিকুমরুল এলাকার মৌচাষী আব্দুর রশিদ জানান, চলতি মৌসুমে সরিষা ফুল থেকে তার খামারের মৌমাছি দিয়ে প্রায় ১২ টন মধু আহরণের আশা করছেন। যা তিনি ১২ হাজার টাকা মন দরে পাইকারি বিক্রি করবেন। তার মতো প্রায় তিন শতাধিক মৌচাষী এই মৌসুমে সিরাজগঞ্জসহ চলনবিল এলাকা থেকে সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ করবে। এর মাধ্যমেও কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক বেকার খামারি যুবকের। পাশাপাশি উৎপাদিত মধু দেশের বাজারের চাহিদা পূরণ করায় আমদানি কমে আসছে।
সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ. জা. মু. আহসান শহীদ সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরিষা ৩ মাস মেয়াদী ফসল। কম খরচ ও কম পরিশ্রমে সরিষা চাষ করতে পারেন কৃষকরা। বর্তমানে সরিষা চাষ কৃষকের কাছে লাভজনক হয়েছে। এবার জেলার ৭১ হাজার কৃষককে সরিষা বীজ ও সার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। গত বছর সরিষার আশানুরূপ ফলন ও দাম পাওয়ায় কৃষকেরা এবারও উৎসাহী হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘সরিষা চাষ একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা বাড়ায়, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি মৌসুমে সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে প্রায় ৪০০ টন মধু আহরণ হবে। আশা করছি, কৃষকরা সরিষার ভালো ফলনে লাভবান হবেন। এখানকার উৎপাদিত সরিষার তেল দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণেও বড় ভূমিকা রাখবে।
সারাবাংলা/পিটিএম