লাভ বেশি, তবু জলাবদ্ধতায় সরিষার আবাদ কমেছে যশোরে ৪ উপজেলায়
২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০৫ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:২১
যশোর: বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাঠের পর মাঠ চোখ ধাঁধাঁনো হলুদ। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নাকে লাগে মাদকতা জড়ানো ঘ্রাণ। একটু কাছে গেলেই ফুলের বুক থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌমাছির গুনগুনানি। যশোরের দিকে দিকে এখন এমনই বিস্তীর্ণ এলাকায় শোভা পাচ্ছে সরিষার ক্ষেত। আবাদ শেষের পথে হওয়ায় ফসল তুলতে সরিষা চাষিদের অপেক্ষার প্রহরও শেষের দিকে।
কৃষক ও কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কম খরচ, কম পরিশ্রম ও বাজারে সরিষার দাম ভালো পাওয়ায় যশোরে চাষিদের মধ্যে দিন দিন সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। তা সত্ত্বেও গত বছরের তুলনায় এ বছর সরিষার আবাদ কমেছে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় সাত হাজার হেক্টর কম জমিতে। কৃষি বিভাগ অবশ্য এর জন্য চার উপজেলার জলাবদ্ধতাকে মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জেলায় সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর। আবাদ হয়েছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি— ৩১ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি এক দশমিক ৩৯ মেট্রিক টন হিসাবে সরিষার উৎপাদন ছিল ৪৩ হাজার ৮৯৫ মেট্রিক টন। এরপর এ মৌসুমে জেলায় সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়েছিল ৩২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে, তবে আবাদ হয়েছে ২৫ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমিতে।
কৃষি বিভাগ বলছে, ভবদহ এলাকার মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধ থাকায় এবার এসব উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জমিতে সরিষার আবাদ সম্ভব হয়নি। আগস্টের ভারী বৃষ্টির কারণে যশোর সদর উপজেলাতেও অনেক জমি ছিল পানির নিচে। আবাদের লক্ষ্যমাত্রা তাই পূরণ হয়নি এ উপজেলাতেও। এই চার উপজেলাতেই কেবল সরিষা আবাদ গত বছরের তুলনায় কমেছে চার হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে।
তথ্য বলছে, গত বছর মণিরামপুরে সরিষা আবাদ হয়েছিল ৩৬৫০ হেক্টর জমিতে, এ বছর তা ১৪৯০ হেক্টর জমিতে নেমে এসেছে। কেশবপুরে গত বছরের ২১৫০ হেক্টর জমির বিপরীতে এ বছর আবাদ নেমে এসেছে ১৩৫০ হেক্টর জমিতে। সদরে গত মৌসুমের ৪২২৫ হেক্টর জমির জায়গায় এ বছর আবাদ হয়েছে ২৮৭০ হেক্টর জমিতে। চার উপজেলার মধ্যে কেবল অভয়নগরে আবাদ হয়েছে একটু বেশি— গত বছরের ২১১০ হেক্টর জমির বিপরীতে এ বছর আবাদ হয়েছে ১৮০০ হেক্টর জমিতে।
কৃষকরা বলছেন, স্বাভাবিকভাবে ছিটানো সরিষা আবাদে বিঘায় চার থেকে পাঁচ মণ এবং উন্নত জাতের সরিষায় সাধারণত ছয় থেকে সাত মণ সরিষার ফলন পাওয়া যায়। বর্তমান বাজারদর হিসেবে এর সর্বনিম্ন দাম ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। তাছাড়া সরিষা থেকে তেল উৎপাদন করলে সরিষার খৈলও বিক্রি করতে পারেন কৃষক, যা দেয় বাড়তি টাকা।
কৃষি বিভাগ বলছে, সরিষার আবাদ জমির উর্বরতা বাড়ানোর মাধ্যমে শস্য আবর্তনের কাজও করে থাকে। এতে বিঘায় কৃষকের খরচ হয় সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা। অন্যদিকে উৎপাদিত সরিষা থেকে কৃষকের আয় এই খরচের তিন থেকে চার গুণ। উন্নত জাতের সরিষা আবাদ করলে এই আয় আরও বেশি। ফলে সরিষা কৃষকের জন্য আর্থিক ও জমির স্বাস্থ্য— দুই বিবেচনাতেই কার্যকর একটি ফসল।
সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবে সাম্প্রতিক সময়ে সয়াবিন বা পাম তেলের তুলনায় সরিষার তেলের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে বাজারে সরিষার তেলের সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ তৈরি হয়েছে। এ কারণেও কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন সরিষা আবাদে। এতে সরিষা চাষ এখন বাড়তির দিকে।
সরিষা আবাদে বহুমুখী লাভের কথা তুলে ধরে যশোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সমরেণ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, সরিষার কিছুই ফেলনা নয়। জমিতে উৎপাদিত সরিষা কৃষকের জন্য লাভজনক ফসল। তাছাড়া সরিষা গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সরিষা থেকে তেল উৎপাদনের পর খৈল ব্যবহার করা হয় উচ্চ মানের জৈবসার, গবাদি পশুর খাবার এবং মাছের খাবার হিসেবে। ফলে সরিষা আবাদ থেকে কৃষকের লাভ বহুমুখী।
যশোর সদরের সুলতানপুর মাঠে প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। সেখানে কথা হয় সরিষা চাষি মাহফুজ বিল্লাহ, আজাদ ও সাইফুল্লাহর সঙ্গে। তারা বলছেন, তারা নিজেরা ও তাদের আত্মীয়দের অনেকেই একেকজন তিন থেকে সাত বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছেন। বারি ও বিনার বিভিন্ন উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা লাগিয়েছেন তারা।
কৃষকরা বললেন, সরিষা আবাদে খরচ কম লাগে, পরিশ্রমও অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম। কিন্তু সরিষার ফলন ভালো। উচ্চ ফলনশীল জাত আবাদ করলে ফলন আরও বেড়ে যায়। বাজারে সরিষার তেলের কারণে সরিষার চাহিদা বেশি হওয়ায় দামও পাওয়া যায় ভালো। এ কারণে তারা নিয়মিত সরিষা আবাদ করে আসছেন।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক সমরেণ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে আগ্রহ থাকলেও আগস্টের ভারী বৃষ্টির কারণে চার উপজেলায় অনেক জমি আবাদযোগ্য ছিল না। ভবদহের জলাবদ্ধতার কারণেও অনেক জমিতে আবাদ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে গত বছরের তুলনায় জেলায় সরিষার আবাদ কম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সরিষার উৎপাদনও কিছুটা কম হবে। তবে ব্যক্তি পর্যায়েও এখন সরিষা চাষে আগ্রহ বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এই কর্মকতা আরও বলেন, মৌসুমের শুরুতেই অন্তত সাড়ে তিন হাজার টাকা মণ দরে সরিষা বিক্রি হয়েছে। বর্তমান বাজারে এর দাম চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। ফলে কৃষক কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।
সারাবাংলা/এনজে/টিআর