‘কত পরশু এলো-গেলো, ভাইয়া আর এলো না’
১৫ জুন ২০১৮ ১০:০৩
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, কবে আসবা? সে বললো, পরশু আসবো। এরপর থেকে কত পরশু এলো-গেলো, ভাইয়া আর এলো না। ভাইয়া আর আসবেও না।’ —এটুকু বলেই কান্না সামলাতে কথা থামিয়ে দেন দুই বাসের চাপায় হাত হারিয়ে মারা যাওয়া রাজীবের খালাতো ভাই আসিফ জাহান অমি।
অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে অমি বলেন, ‘আমি আর ভাইয়া (রাজীব) একসঙ্গে বড় হয়েছি। সবার চেয়ে ভাইয়ার সঙ্গে আমার স্মৃতি বেশি, আমি সেই ভাইকে কী করে ভুলি।’ —এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে অমি। তার সঙ্গে কেঁদে ওঠে রাজীবের ছোট দুই ভাই মেহেদী আব্দুল্লাহ, দুই খালা আর মামা।
আসিফ জাহান অমি বলে, ‘রাজীব ছিলো আমাদের সবার বড় ভাই, সেই ভাইকে ছাড়া আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।’ অমি যখন কথা বলছে, তখন অমির বোন সাড়ে তিন বছরের অহনা মোবাইলে বসে রাজীবের ছবি দেখছে। ছবি দেখতে দেখতে নিজের মনে বলছে, ‘রাজীব ভাইয়া আমাকে চকলেট-লিপস্টিক কিনে দিতো। আমার বুকের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে, রাজু ভাইয়া আর আসবে না।’
গত ৩ এপ্রিল দুই বাসের রেষারেষিতে প্রথমে হাত হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭ এপ্রিল রাজীব মারা যান। মৃত্যুর পর বাবা-মা হারানো রাজীবের দুর্ঘটনা দেশে আলোড়ন তোলে, সড়ক দুর্ঘটনারোধে সোচ্চার হয় দেশের সাধারণ মানুষ। ক্ষতিপূরণের দাবিতে উচ্চ আদালতে রিট করা হলে রাজীবের দুই ভাইকে ১ কোটি ক্ষতিপূরণের নির্দেশও দেয় আদালত।
অমি আর অহনা রাজীবের খালা জাহানারা বেগমের সন্তান। এই খালার বাসা থেকেই ঢাকায় লেখাপড়া শুরু করেন রাজীব। গত ৯ জুন রাজধানীর মতিঝিলে রাজীবের বড় খালা জাহানারা বেগমের বাসায় গিয়ে দেখা যায় নিহত রাজীবের স্মৃতি এই পরিবারে প্রতিটি মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার প্রমাণ ছোট্ট অহনা। জানা গেল, সাড়ে তিন বছরের অহনা মায়ের মোবাইল ফোনে শুধুই রাজীবকে নিয়ে করা সংবাদের প্রতিবেদন দেখে ইউটিউবে।
রাজীবের আপন দুই ভাই আব্দুল্লাহ আর মেহেদী বলে, ‘আগে আমাদের পরিচয় ছিল রাজীবের ভাই। আর এখন লোকে আমাদের বলে, দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারিয়ে মারা যাওয়া রাজীবের ভাই।’
রাজীবের খালা জাহানারা বেগম বলেন, ‘রাজীবের বাবা মারা যাবার পর ঢাকায় আমার কাছে নিয়ে এসে পোস্ট অফিস হাইস্কুলে ভর্তি করাই, তখন অমি ছোট। ওরা একসাথে বড় হইছে, তাই হয়তো অমির সঙ্গেই বেশি স্মৃতি।’
এ সময় পাশে বসা রাজীবের মেঝ ভাই মেহেদী হাসান বলে, ‘বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমরা তিনভাই একসঙ্গে নামাজ পড়তে যেতাম। অথচ আমাদের বড় ভাই আজ নেই, এবার আর আমাদের তিনজনের একসঙ্গে নামাজ পড়তে যাওয়া হবে না। গতবারও আমরা তিনভাই মিলে একসঙ্গে নামাজ পড়েছি। সে সবসময় বলতো, আমার দুইপাশে দুই ভাই, দুজনই হাফেজ। সবসময় আমাদের নিয়ে গর্ব করতো। এইবার আমরা দেশে যাচ্ছি ঈদ করতে, সেই ভাই নেই। ভাইয়ের কবর জিয়ারত করে এবারে আমাদের ঈদ করতে হবে। আমরা আনন্দ করতে যেতাম অথচ আমাদের সেই সুখটা নাই হয়ে গেল।’
ছোট ভাই আব্দুল্লাহ একটু চুপচাপ, ক্ষীণ কণ্ঠে আব্দুল্লাহ বলে, ‘ভাইয়া আমাদের জন্যই সবসময় কষ্ট করছে। সবসময় একাধিক টিউশনি করতো, টাকা ইনকাম করলে আমাদের ভালো রাখতে পারবে বলে। আমাদের মাদ্রাসার পাশে মেসে থাকতো কিন্তু সেই ভাই আজ কতদূরে। আমরা ভালো আছি নাকি খারাপ আছি, সেটা দেখার জন্য আমাদের ভাই আর কোনোদিন ফিরবে না।’
জানা যায় রাজীব মারা যাবার পর তার নামে ছয়টা ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে। কার্ডগুলো দেখিয়ে আব্দুল্লাহ বলে, ‘হয়তো কোথাও তার একটা চাকরি হয়ে যেত। আর তারপরই আমরা একসঙ্গে থাকতাম। ভাইয়া মারা গেছে মানে আমাদের সব শেষ হয়ে গিয়েছে।’
আদালতে চলা মামলাটি যদি দ্রুত শেষ করা যায়, তাহলে আমাদের জন্য খুব ভালো হয় জানিয়ে মেহেদী হাসান বলে, ‘প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি সব সবার কাছে আবেদন, মামলটার যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। যদি ক্ষতিপূরণের টাকাটা পাই তাহলে তো লেখাপড়াটা চালিয়ে নিতে পারবো।’ যে দুই বাসের রেষারেষিতে ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায় মেহেদী ও আব্দুল্লাহ।
সারাবাংলা/জেএ/এমও