বিচারক নিয়োগে স্বতন্ত্র কাউন্সিল গঠনের দ্বারপ্রান্তে বিচার বিভাগ
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৪২
ঢাকা: বিচার বিভাগ স্বতন্ত্রীকরণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য বিচার বিভাগ স্বতন্ত্র কাউন্সিল গঠনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বের) সুপ্রিম কোর্টের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলামের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের উদ্দেশে দেওয়া অভিষেক বক্তব্যে ও পরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ইনার কোর্ট ইয়ার্ডে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের বিচারপতি ও জেলা বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করা বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার আনা, বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাসহ বিচার বিভাগে মেধার চর্চার উন্মেষের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে উন্নত দেশগুলোর মতো সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এরই অংশ হিসেবে গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণে হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথরূপে পালনের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং রুলস অব বিজসেন ও অ্যালোকেশন অব বিজনেসের সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে পরিপূর্ণ প্রস্তাব পাঠানো হয়।
পরে গত ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির তিনজন কর্মকর্তা আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রস্তাবিত বিচার বিভাগীয় সচিবালয়ের বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় সম্পর্কে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। এর ফলে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের বিষয়টি পুনরায় বেগবান হয়। বর্তমানে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় তৈরির বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে সক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়াধীন। আশা করা যায়, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ শিগগিরই দৃশ্যমান হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া গত ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কাজ চলমান।
প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণের পর এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কর্মরত বিচারপতিদের মতামত নিতে গত ১৪ নভেম্বর ওই খসড়া বিচারপতিদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বিচারপতিদের কাছ থেকে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত মোট ১৫টি মতামত পাওয়া যায়। এগুলো নিরীক্ষা করে সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশটি গত ২৮ নভেম্বর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ওই প্রস্তাবে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য একটি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে এ রকম স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো প্রস্তাবেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাইয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করার জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে ওই কাউন্সিলের সদস্য হবেন ১০ জন।
প্রধান বিচারপতি হবেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। কাউন্সিলের সদস্য হবেন কর্মে প্রবীণতম আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক ও দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারক, কর্মে প্রবীণতম হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক, অধস্তন আদালতের বিচারক থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন এমন বিচারকদের মধ্য থেকে কর্মে প্রবীণতম একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইনের অধ্যাপক ও দুজন নাগরিক প্রতিনিধি।
প্রস্তাবটিতে নাগরিক প্রতিনিধি নিযুক্ত করার নিয়ামাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, কাউন্সিলের শিক্ষক সদস্য ছাড়া অন্যান্য সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তে প্রণয়ন করা বিধি অনুযায়ী কিংবা এমন বিধি না হওয়া পর্যন্ত কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের লিখিত আদেশ অনুযায়ী দুই বছরের জন্য দুজন নাগরিক সদস্য নিযুক্ত হবেন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে উপযুক্ত প্রার্থীকে সুপারিশ করাসহ কাউন্সিলের যেকোনো সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে নিতে হবে। সংবিধানের ৯৫ ও ৯৮ অনুচ্ছেদের অধীনে বিচারক নিয়োগের জন্য সুপারিশ দিতে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে অনুরোধ এলে কাউন্সিল সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে বলেও প্রস্তাবে সুপারিশ করা হয়েছে।
সারাবাংলা/কেআইএফ/টিআর
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগ বিচারক নিয়োগ স্বতন্ত্র কাউন্সিল